বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক উড়োজাহাজ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বোয়িং থেকে পঁচিশটি নতুন উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এই সিদ্ধান্ত এসেছে বাণিজ্য ঘাটতি হ্রাস এবং রপ্তানিপণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত উচ্চ শুল্ক কমানোর কৌশল হিসেবে। কিন্তু এই বড় ধরনের ক্রয়চুক্তির বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থা অবহিত নয়, যা প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবকে স্পষ্ট করে তুলেছে। প্রশ্ন উঠছে—এটি কি একটি সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কৌশল, না কি কেবল তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক প্রয়াস?
বাণিজ্য ঘাটতি ও শুল্কের চাপে বাংলাদেশের অবস্থান
বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ছয়শ কোটি মার্কিন ডলার, যা টাকায় দাঁড়ায় প্রায় ছেষট্টি হাজার কোটি। যুক্তরাষ্টে বাংলাদেশের রফতানি বেশি হলেও আমদানী কম হওয়ায় এই ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানিপণ্যে গড়ে ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হয়েছে, যা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি থাকায় তারা কম শুল্কে রপ্তানি করতে পারে। ফলে বোয়িংয়ের মতো বিশাল অঙ্কের ক্রয়াদেশ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে বিনিময়ে শুল্ক ছাড় আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সমন্বয়হীন সিদ্ধান্ত ও তার আর্থিক ঝুঁকি
এই ক্রয়চুক্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজ্ঞতা প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতার বড় উদাহরণ। বোয়িংয়ের প্রতিটি উড়োজাহাজের গড় মূল্য প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে পঁচিশটি উড়োজাহাজ কিনতে সরকারের প্রাথমিক আর্থিক দায় দাঁড়াতে পারে প্রায় সত্তর হাজার কোটি টাকা। এটি বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত যদি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মধ্যে পূর্ব সমন্বয় ছাড়া নেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় ও দায়বদ্ধতায় গুরুতর সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
বৈদেশিক রিজার্ভ ও ঋণ পরিস্থিতির বাস্তবতা
বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে দুই হাজার আটশো কোটি মার্কিন ডলারে, যেখানে দুই বছর আগে তা ছিল চার হাজার সাতশো কোটি ডলারেরও বেশি। সরকার ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে বোয়িংয়ের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পে বিনিয়োগ ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, যদি এর পেছনের কূটনৈতিক কৌশল থেকে প্রত্যাশিত সুফল না আসে।
ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতি ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
বিমানবহর সম্প্রসারণের জন্য দরকার প্রশিক্ষিত জনবল, প্রযুক্তিগত যন্ত্রাংশ, রক্ষণাবেক্ষণ অবকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক রুট ব্যবস্থাপনা। এই দিকগুলোতে দেশের প্রস্তুতি কতটা কার্যকর ও টেকসই, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। যদি এসব উড়োজাহাজ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার উপযোগী না হয়, তাহলে সংরক্ষণ, ব্যবহার এবং ঋণ পরিশোধ প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়বে। এতে রাষ্ট্রীয় খরচ বৃদ্ধি এবং বাজেট ঘাটতি বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
কূটনীতির সফলতা নির্ভর করছে শুল্ক আলোচনার ওপর
এই সিদ্ধান্তের পেছনে যে কূটনৈতিক বিবেচনা রয়েছে, তা সফল হবে কি না তা নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনার ফলাফলের ওপর। যদি ওয়াশিংটন থেকে আগামী এক মাসের মধ্যে পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক হ্রাসের ঘোষণা আসে, তবে বোয়িং কেনার সিদ্ধান্তটি যৌক্তিকতা পেতে পারে। কিন্তু শুল্ক হ্রাস না হলে এই বিশাল বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনার অভাব
এই ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট—বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ ধরনের উচ্চ ব্যয়ের আন্তর্জাতিক চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক কৌশলের অভাব স্পষ্ট। কেবল রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কারণেই যদি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে তার নেতিবাচক প্রভাব দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর পড়তে বাধ্য। তাই এখনই প্রয়োজন একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা কাঠামো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ করা।