রাতের শুরুটা ছিল শান্ত
বান্দরবানে রাতের সৌন্দর্য অদ্ভুত এক মুগ্ধতা এনে দেয়। পাহাড়, অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর দুর্ভেদ্য নীরবতা — সব মিলিয়ে এক রহস্যময় পরিবেশ। আমরা চার বন্ধু – তানিম, রাকিব, শোভন আর আমি – সন্ধ্যার পর পাহাড়ি পথে ট্র্যাকিংয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য ছিল — চিম্বুক পাহাড়ে রাতের তারাভরা আকাশ দেখা, আর রোমাঞ্চ অনুভব করা।
বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা
সকালবেলা আমরা মুরং পাড়ার দিক দিয়ে উঠে গিয়েছিলাম চিম্বুকের কাছে এক ছোট্ট আদিবাসী কটেজে। সন্ধ্যায় একটু বিশ্রাম নিয়ে হেডল্যাম্প আর টর্চলাইট হাতে শুরু করলাম রাতের যাত্রা। শুরুতে পথটা সহজ ছিল। পাহাড়ি বাতাসে শরীর হালকা লাগছিল। কিন্তু আধা ঘণ্টা যেতে না যেতেই শুরু হলো প্রকৃতির ভিন্ন রূপ।
বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, কেউ যেন অনুসরণ করছে। মাঝে মাঝে ঝোপের আড়ালে কিছুর নড়াচড়া টের পাচ্ছিলাম। আমরা থেমে তাকাই, কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা আর কৌতূহল – ভয় আর রোমাঞ্চ একসাথে।
রাতের আকাশ আর অচেনা আওয়াজ
পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সাড়ে দশটা। চারপাশে নেমে এসেছে এক গভীর অন্ধকার। দূরে কোথাও একটা পেঁচা ডাকছে। আমরা বসে পড়লাম এক খোলা জায়গায়, যেখানে আকাশ ভরে উঠেছে অসংখ্য তারা দিয়ে। হঠাৎ দূরের জঙ্গলে এক অদ্ভুত আওয়াজ — যেন কেউ হু হু করে কাঁদছে, আবার যেন বাতাসে চাপা গর্জন।
রাকিব কিছুটা ভীত স্বরে বলল, “এটা কি বন্য হাতির ডাক?”
তানিম গম্ভীর গলায় বলল, “হাতির না হলে বুনো শুয়োর হতে পারে। তবে চলো, নিরাপদ দূরত্বে থাকি।”
আমরা সবাই একত্রে হাঁটতে শুরু করলাম পাশের এক বাঁশবনের দিকে। হঠাৎ করেই আমাদের টর্চ নিভে গেল।
গা ছমছমে অভিজ্ঞতা
চারপাশে তখন কেবল ঘন অন্ধকার। আমরা হেডল্যাম্পের আলোতে কোনোভাবে পথ খুঁজে নিচ্ছি। হঠাৎ শোভন হকচকিয়ে থেমে গেল — “ওইটা কী?”
দূরে কিছু একটা চলমান ছায়া দেখা গেল। সবাই থেমে দাঁড়ালাম। ছায়াটা যেন গাছের আড়ালে থেকে আমাদের দেখছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সেটা জঙ্গলের গভীরে মিলিয়ে গেল।
আমরা সাহস করে আবার হাঁটা শুরু করলাম, কিন্তু এবার চারদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। যেন বনজঙ্গলও নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে। একসময় পাড়ার আলো দেখতে পেলাম – তখনই মনে হলো আমরা সত্যিই নিরাপদ।
ফিরে এসে নতুন উপলব্ধি
রাত তখন একটা। আমরা কটেজে ফিরে এলাম ক্লান্ত, ঘেমে, কিন্তু এক অদ্ভুত তৃপ্তি নিয়ে। জীবনে এমন রাত খুব বেশি আসে না — যেখানে প্রকৃতি নিজের গা ছমছমে রূপ দেখায়, যেখানে বন্ধুত্ব আর সাহস একসাথে পরীক্ষা দিতে হয়।
পরদিন সকালে মুরং পাড়ার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোককে গতরাতের আওয়াজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি হেসে বললেন, “ওটা পাহাড়ি শিয়ালের ডাক। মাঝেমাঝে ওরা মানুষকে ভয় দেখাতে ভালোবাসে।”
শেষ কথা
বান্দরবানের রাত শুধু সুন্দর নয়, রহস্যে ঘেরা। সাহস থাকলে সেই রহস্যময়তার ভেতর ঢুকলেই বোঝা যায় — প্রকৃতি কতটা জীবন্ত, আর রাতের যাত্রা কতটা উত্তেজনায় ভরা। আমাদের সেই রাতের যাত্রা সারাজীবন মনে থাকবে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হিসেবে।