পুরনো ঢঙে চিরনতুন চা ছান তেং
মধ্যদুপুরের প্রখর রোদে যখন সাধারণত কেবল ‘পাগল কুকুর আর ইংরেজ’ ঘর ছাড়ে বলে মনে করা হয়, তখন হংকংবাসীরাও ভিড় জমায় ল্যান ফং ইউয়েন ক্যাফেতে। ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই ‘চা ছান তেং’ বা চা রেস্টুরেন্টটির চেহারা আজও একই রকম। ঝকঝকে কোনো পরিবেশ নয়—পুরনো ফর্মিকা টেবিল, ঘাম ঝরানো ভিড় আর সুগন্ধ ছড়ানো ভাজাভুজি। তবুও কনডেন্সড মিল্ক মাখানো টোস্ট কিংবা খাসি মাংসের বানে যারা একবার খেয়েছেন, তারা জানেন এই ক্যাফে কেবল খাওয়ার জায়গা নয়, বরং এক সাংস্কৃতিক আচার।
ঔপনিবেশ ইতিহাসে জন্ম, পূর্ব-পশ্চিমের সংমিশ্রণ
ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনের সময় মূল চীন থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য এই ক্যাফেগুলো গড়ে ওঠে। খাবারগুলোও এক ধরনের ক্যান্টো-ওয়েস্টার্ন ফিউশন—যেমন, অতিমিষ্ট কনডেন্সড মিল্কের ‘নাই চা’ (দুধ চা), কিংবা চা-কফির মিশেল ‘ইউনইয়ুং’। প্রথমে এসব স্বাদ সহজে মেনে নেওয়া কঠিন হলেও পরে তা হয়ে ওঠে হংকংয়ের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকংয়ের গবেষক সিডনি চিউং বলেন, “চা ছান তেং হংকংয়ের সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তির প্রতীক।”
রাজনৈতিক দমন, সংস্কৃতির ক্ষয়
২০২০ সালের গ্রীষ্মে জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর হংকংয়ে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বাড়ে। গত পাঁচ বছরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ শহর ছেড়েছে। কিছু চা ছান তেংকে ‘হলুদ’ বা গণতন্ত্রপন্থী ব্যবসা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাদের অনেকে ভাড়া নবায়নে সমস্যায় পড়ে এবং ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হয়।
দেশান্তরের সঙ্গে চা ছান তেংয়ের দেশান্তর
যারা হংকং ছেড়েছেন, তারাও এই চা ছান তেং সংস্কৃতিকে তাদের নতুন ঠিকানায় নিয়ে গেছেন। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা ও তাইওয়ানে নতুন নতুন চা ছান তেং খোলা হয়েছে। শুধু সিডনির বারউড এলাকাতেই খোলা হয়েছে সাতটি চা ছান তেং। তাইপের ‘সেপ্টেম্বর ক্যাফে’র মালিক অ্যান্ডি ল্যাম বলেন, “বিদেশে বসে নিজের দেশের স্বাদ পাওয়া এক ধরনের মানসিক শান্তি দেয়।”
আকর্ষণ বাড়ছে বিশ্বব্যাপী
তবে শুধু হংকংয়ের অভিবাসীরাই নয়, স্থানীয়রাও আগ্রহ দেখাচ্ছেন। অনেক চা ছান তেং স্থানীয় স্বাদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে—মিষ্টির মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। টিকটকে #chachaanteng হ্যাশট্যাগে দেখা হয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখের বেশি বার। তরুণ প্রজন্মও এই অবাধ, খোলামেলা পরিবেশের খাবারের দোকানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
পশ্চিমেও জনপ্রিয়তা
জনপ্রিয় রন্ধনশিল্পী লুকাস সিন এই ক্যাফেগুলোর ওপর একটি রান্নার বই লিখছেন। ইউরোপের শীর্ষ শিল্পমেলা আর্ট বাসেল ২০২৪ সালে প্যারিসে একটি চা ছান তেং পপ-আপ চালু করে। সেটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, পরবর্তীতে মিয়ামি ও এমনকি হংকংয়েও অনুরূপ পপ-আপ চালু করা হয়।
পুরনো হংকংয়ের স্মৃতির স্বাদ
২০২১ সালে নিউ ইয়র্কে ‘আঙ্কেল লু’ নামে একটি ক্যান্টনিজ ডাইনিং চালু করেন ল্যারি ফাং। তার মতে, এই ক্যাফেগুলো এক ধরনের ‘নস্টালজিয়া’ বা হারিয়ে যাওয়া অতীতের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। অনেক হংকংবাসীর কাছে এক কাপ ‘নাই চা’ বা ‘ইউনইয়ুং’-এ আজও বাস করে এক ভিন্ন হংকংয়ের স্মৃতি।
চা ছান তেং: একটি চলমান ইতিহাস
চলমান দমন-পীড়ন ও অভিবাসনের ঢেউয়ে অনেক ক্যাফে বন্ধ হয়ে গেলেও, এখনো হংকং শহরে প্রায় ছয় হাজার চা ছান তেং টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়। দেশীয় সংস্কৃতির বাহক এই ফিউশন ক্যাফেগুলো আজ বৈশ্বিক পরিচয় পাচ্ছে নতুন প্রজন্ম ও নতুন ভূগোলে।
চা ছান তেং এখন কেবল হংকংয়ের রাস্তায় নয়, নিউ ইয়র্ক থেকে সিডনি পর্যন্ত বিস্তৃত। স্বাদের চেয়েও এগুলো এক ধরনের অনুভূতির প্রতীক—এক অতীতের, এক সংস্কৃতির, এক স্বপ্নের, যা হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অল্প বিস্কুট আর এক কাপ নাই চায়ে এখনো বেঁচে আছে।