এক দোকানির কথায় ফুটে উঠল জনগণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের নির্মম সত্য
“গত বছর আমি ৪৮ হাজার কেজি আম বিক্রি করেছিলাম। এ বছর মাত্র ১২ হাজার কেজি বিক্রি হলো, তাও ক্রয়মূল্যের অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়েছে কিছু অংশ। সেটুকু লস দিয়েই বিক্রি করেছি।” অনলাইন শপের এই ফল ও মাছ বিক্রেতার দোকানের এই একটি লাইন যেন বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতির গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি।
এ বছর তার দোকানের ফেসবুক পেজে পরপর পাঁচ দিন বড় আকৃতির ইলিশ মাছের ছবি পোস্ট করা হয়েছিল। ছবিতে প্রতিটি মাছই আকর্ষণীয় ও বাজারজাত করার জন্য উপযুক্ত। কয়েকজন গ্রাহক পোস্টে কমেন্ট করে মাছের দাম জানতে চেয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি মাছও বিক্রি হয়নি।
এই অভিজ্ঞতা শুধু এক দোকানির নয়—বরং এটি পুরো দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের বাস্তব প্রতিফলন।
আমদানি মূল্য আর বিক্রয় মূল্যের বিশ্লেষণ
গত বছর যেখানে তিনি ৪৮ হাজার কেজি আম বিক্রি করেছিলেন, এবার বিক্রি হয়েছে মাত্র এক-চতুর্থাংশ। সেটাও ক্ষতিতে। এর মানে দাঁড়ায়—বাজারে আগের মতো চাহিদা নেই, মানুষের হাতে নগদ টাকার অভাব রয়েছে এবং ফলমূলের মতো তথাকথিত বিলাসী পণ্যের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে।
বড় আকৃতির ইলিশ মাছ, তবুও কেউ কেনে না
দোকানির কথায়, “ইলিশ মাছের ছবি দেখে অনেকে লাইক, কমেন্ট করে, দাম জানতে চায়। কিন্তু বাস্তবে একটি মাছও বিক্রি হয়নি।” অতীতে এমন হলে ছবির পোস্টের পরপরই অনেক অর্ডার আসত। কিন্তু এ বছর কয়েকটি পোস্টের পরও শূন্য সাড়া। এটি শুধু বাজার মন্দা নয়, বরং সরাসরি ভোক্তার হাতের টাকাহীনতার ইঙ্গিত।
একজন কর্মজীবী মানুষ আগে যেভাবে মাস শেষে সামান্য সঞ্চয় থেকে একটি ইলিশ কিনে উৎসব করতেন, এখন তার পকেটে বাজার করার পর আর অতিরিক্ত কিছু কেনার সামর্থ্য থাকছে না।
অর্থনীতির চিত্র: পরিসংখ্যান বলছে কী?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৯.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি তো ১১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অথচ একই সময়ে গড় আয় বেড়েছে মাত্র ৪-৫ শতাংশ, এবং বেশির ভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারে আয় বাড়েনি একটুও—বরং কমেছে অনেক ক্ষেত্রে।
এই বাস্তবতায় মানুষ বাধ্য হচ্ছে:
- আম বা মৌসুমি ফল না খেতে
- মাছের মতো উচ্চমূল্যের প্রোটিন গ্রহণ না করতে
- প্রয়োজনীয় পণ্য বাছাইয়ের সময় ন্যূনতম খরচের ওপর নির্ভর করতে
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জীবনযাপন সংকুচিত
২০২৫ সালে গৃহস্থালি ব্যয় বাড়লেও বেতন, আয় বা চাকরি বাড়েনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম বেড়েছে। বাজারে ডিম, ডাল, তেল, চাল, মাংস—সবকিছুর দাম প্রায় দ্বিগুণ। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ফল বা মাছের মতো অতিরিক্ত খাবারকে বিলাসিতা মনে করছে।
দোকানিদের মতো অনেক খুচরা ব্যবসায়ী জানান, “মানুষ এখন শুধু চাল, ডাল, তেল কেনে। মাছ বা ফলের দিকে তাকায়ও না।” এর অর্থ—ভোক্তার দৈনন্দিন খাদ্যচাহিদাও পূরণ হচ্ছে সীমিত পরিসরে।
সরাসরি প্রভাব: কৃষক, খুচরা বিক্রেতা ও শ্রমজীবীদের ক্ষতি
ভোক্তা যেমন অসহায়, উৎপাদক ও বিক্রেতারাও তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষক দাম পাচ্ছেন না, ব্যবসায়ী লস দিয়ে বিক্রি করছেন, ফলে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে, দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পুরো অর্থনীতিতে এক ধরনের দুষ্টচক্র কাজ করছে—ক্রয়ক্ষমতা কমার কারণে পণ্য বিক্রি কমছে, পণ্য বিক্রি কমায় ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কর্মসংস্থান কমছে।
চোখে আঙুল দিয়ে
একজন ছোট দোকানির আম ও ইলিশ বিক্রির অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—বাংলাদেশের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কতটা কমে গেছে। অর্থনীতির এই সংকট শুধু পরিসংখ্যানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এখনই যদি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে আগামী দিনে ভোক্তা, ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্র—তিন পক্ষই আরও বড় ধসের মুখোমুখি হবে।