নিউইয়র্কে একটি টেবিলের গল্প
১৯৯৮ সালের একটি জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’-তে ক্যারি ও সামান্থা ম্যানহাটনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফরাসি রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে চেয়েছিলেন। রিজার্ভেশন না থাকায় তারা ঢুকতে পারেননি। তবে এক সময় সেই রেস্টুরেন্টের হোস্টেস জরুরি পরিস্থিতিতে ক্যারির কাছে স্যানিটারি পণ্য চেয়ে বসেন, এবং সাহায্য পাওয়ার পরই ওই দুই নারীকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয়। পরে ক্যারি বলেন, “সেই মুহূর্ত থেকেই বোলজাকে টেবিল পেতে আমাদের আর কোনো সমস্যা হয়নি।”
এই ঘটনা রসাত্মক হলেও বাস্তবে এখন আর এমন কৌশল সহজে কাজ করে না। কোভিড মহামারির পর আমেরিকায় রেস্টুরেন্টের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে বহুগুণে। রান্না করার অক্ষমতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাবকদের ভোজন বিলাসিতা দেখানো এবং ‘ভাইব’-এর প্রতি আকর্ষণ মানুষকে রেস্টুরেন্টমুখী করে তুলেছে।
ধনী ও বিখ্যাতদের জন্য বিশেষ সুবিধা
সাধারণ মানুষ এখন আর কেবল ‘টিপস’ দিয়ে টেবিল পায় না। বরং, ধনীদের জন্য আলাদা পথ আছে। আমেরিকান এক্সপ্রেসের ‘ব্ল্যাক কার্ড’ ব্যবহারকারীরা বছরে ১৫,০০০ ডলার ফি দিয়ে পছন্দের রেস্টুরেন্টে বিশেষ অ্যাক্সেস পান। এমনকি কিছু ওয়াল স্ট্রিট কোম্পানি মাসে হাজার হাজার ডলার খরচ করে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে নিজেদের কর্মীদের জন্য টেবিল নিশ্চিত করে।
নতুন ব্যবসার জন্ম: অ্যাপয়েন্টমেন্ট ট্রেডার
এই প্রেক্ষাপটে ২০২১ সালে জোনাস ফ্রে নামের এক জার্মান প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ‘Appointment Trader’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম চালু করেন। মায়ামিতে থাকা এই ব্যক্তি প্রতি সপ্তাহে ছয় দিন বাইরে খাওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত। তার তৈরি প্ল্যাটফর্মে একজন ব্যবহারকারী রিজার্ভেশন চাইলে সেটি বিক্রির উদ্দেশ্যে অন্য কেউ সেটি অফার করতে পারেন। দাম নির্ধারিত হয় চাহিদা অনুযায়ী।
রেস্টুরেন্ট মালিকদের ক্ষোভ ও আইনি লড়াই
প্রথমে বিষয়টি ধরতে না পারলেও পরে রেস্টুরেন্টগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। তাদের আপত্তি তিনটি প্রধান বিষয়ে:
১. নিয়ন্ত্রণ হারানো: Appointment Trader রেস্টুরেন্টের নিয়ন্ত্রণ থেকে টেবিল বিক্রির বিষয়টি ছিনিয়ে নিয়েছে এবং তৃতীয় পক্ষ এতে লাভ করছে।
২. গ্রাহকের প্রত্যাশা ভাঙা: অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে টেবিল কিনলেও রেস্টুরেন্ট এই তথ্য না জানে, ফলে সেবা না মেলে এবং গ্রাহক অসন্তুষ্ট হন।
৩. বট এবং ‘নো-শো’-এর অভিযোগ: তাদের দাবি, সাইটে স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রাম (বট) ব্যবহৃত হয় যা অতিরিক্ত রিজার্ভেশন করে রাখে, কিন্তু আসলে কেউ আসে না। এতে রেস্টুরেন্টে টেবিল ফাঁকা থাকে এবং আর্থিক ক্ষতি হয়।
তবে ফ্রে দাবি করেন, শেষ ৫০,০০০ লেনদেনের মাত্র ১ শতাংশ ‘নো-শো’ ছিল। যেখানে শিল্পে গড় অনুপস্থিতির হার প্রায় ৩০ শতাংশ।
আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টা
জাতীয় রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, রেজি (Resy) ও ওপেনটেবিল (OpenTable) একত্রে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ‘রিজার্ভেশন পাইরেসি’ নিষিদ্ধ করতে লবিং করছে। ২০২৪ সালে নিউইয়র্কে Appointment Trader নিষিদ্ধ হয়, এরপর ফ্লোরিডা ও লুইজিয়ানাও একই পদক্ষেপ নেয়। আরও কিছু রাজ্য এই গ্রীষ্মে একই আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এ ছাড়াও ‘SEAT Act’ নামে একটি ফেডারেল বিল আনা হচ্ছে যাতে পুরো আমেরিকায় Appointment Trader নিষিদ্ধ করা যায়।
জোনাস ফ্রের হতাশা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মায়ামির জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট ম্যান্ডোলিনে বসে ফ্রে বলেন, “আমেরিকার বাজার হারানো খুবই কষ্টদায়ক। কিন্তু আমি খুব ছোট প্রতিষ্ঠানটি চালাই, লড়াই করার মতো ক্ষমতা নেই।” এখন তিনি ইউরোপকে কেন্দ্র করে কাজ করতে চান। ইতিমধ্যে ডাচ, ফরাসি ও স্প্যানিশ ভাষায় রেস্টুরেন্ট অনুসন্ধানের সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে।
তার মতে, প্রচলিত রেস্টুরেন্ট রিজার্ভেশন ব্যবস্থা অদক্ষ। Appointment Trader মানুষের জন্য ‘লাক্সারি’ সহজলভ্য করে তুলেছে। যারা টাকা খরচ করতে রাজি, তাদের জন্য বিশ্বসেরা রেস্টুরেন্টে বসার সুযোগ এনে দিয়েছে এই প্ল্যাটফর্ম। ব্যবহারকারীদের বড় অংশ ৩৫ বছরের কম বয়সী।
ফ্রে মনে করেন, রেস্টুরেন্ট মালিক ও আইনপ্রণেতারা যদি অর্থনীতির পাঠ নিতেন, তাহলে বুঝতেন যে তার ওয়েবসাইট শুধুই বাজারের প্রকৃত চাহিদা ও দামের প্রতিফলন। বাজারে টেবিলের দাম ঠিক হয় বাজারের নিয়মে, মেনুর ‘ফিক্সড প্রাইস’-এ নয়।