০৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
শিশুদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে চীনের সঙ্গে একই পথে হাঁটছে পশ্চিমা বিশ্ব পোল্যান্ডের বনে বিরল কালো নেকড়ের ক্যামেরাবন্দি দৃশ্য, সংরক্ষণ ও সহাবস্থানের বিতর্ক নতুন করে শিশিতে বন্দি সৌন্দর্যের মোহ: পরীক্ষাহীন পেপটাইড ইনজেকশনের বিপজ্জনক উত্থান তুরস্কের দাবি: আক্কুয়ু পারমাণবিক প্রকল্পে রাশিয়ার নতুন ৯ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৪৬) শাওমির ১৭ আল্ট্রা ‘লাইকা এডিশন’: স্মার্টফোনে ফিরছে ম্যানুয়াল জুম রিং একাত্তরেও উৎসবের রাজকীয় গ্ল্যামার, লাল শাড়িতে নতুন সংজ্ঞা রচনা রেখার ইউক্রেনের দাবি: রাশিয়ার ওরেনবুর্গে বড় গ্যাস প্রক্রিয়াজাত কারখানায় ড্রোন হামলা দীপু চন্দ্র দাস হত্যাসহ নির্যাতনের প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে হিন্দু মহাজোটের মানববন্ধন শৈত্যপ্রবাহে কাঁপছে বাংলাদেশ, ঢাকাসহ সারাদেশে বেড়েছে শীতের দাপট

বাংলাদেশে নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পে স্থবিরতা: শতশত শিল্পী আয়হীন, সংকটে জীবন

স্থবির শিল্পকষ্টে শিল্পীরা

গত এক বছরে বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পে নজিরবিহীন স্থবিরতা নেমে এসেছে। ছোটপর্দা ও বড়পর্দা—উভয় ক্ষেত্রেই নতুন প্রযোজনার সংখ্যা কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে নাটকের ধারাবাহিক ও একক পর্বের নির্মাণ, চলচ্চিত্রে নতুন চিত্রায়ণও কার্যত স্থগিত। এর ফলে শতশত শিল্পী কাজ না পেয়ে বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

অনেক জনপ্রিয় ও প্রতিশ্রুতিশীল অভিনয়শিল্পী গত এক বছরে মাত্র একটি বা দুটি কাজ পেয়েছেন, কেউ কেউ পুরো বছরেই একটিও প্রজেক্ট পাননি। আয় না থাকায় অনেক শিল্পী পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন, কেউ কেউ পেশা পরিবর্তনের চিন্তায়, কেউ মানসিক চাপের শিকার। কয়েকজন অভিজ্ঞ অভিনেতা জানিয়েছেন, ঘরভাড়াও সময়মতো পরিশোধ করতে পারছেন না।

প্রযোজনা কেন কমেছে?

নাট্যপ্রযোজক ও পরিচালক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, সামগ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, টেলিভিশন বিজ্ঞাপন আয় কমে যাওয়া, সেন্সরবোর্ড ও প্রশাসনিক জটিলতা, ইউটিউব ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগের অনীহা—সব মিলিয়ে প্রযোজকেরা নতুন কাজে নামতে আগ্রহ হারিয়েছেন।

চলচ্চিত্র প্রযোজনা ক্ষেত্রেও একই চিত্র। গত এক বছরে বাংলাদেশে বড় প্রযোজনা সংস্থাগুলোর কেউই উল্লেখযোগ্য কোনো ছবি শুরু করেনি। অনেক সিনেমার শুটিং মাঝপথে বন্ধ হয়েছে অর্থাভাবে।

অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং মূল্যস্ফীতি নাটক-চলচ্চিত্র শিল্পেও প্রভাব ফেলেছে। বিজ্ঞাপন খাতে খরচ কমিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। মিডিয়া হাউসগুলো কর্মী ছাঁটাই করছে, প্রযোজনা ব্যয় সংকুচিত করেছে।

এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাম্প্রতিক মৌলবাদী চাপের কারণে সমাজে একটি আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। অনেক নাট্যকার ও পরিচালক জানান, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর বিষয় এড়িয়ে চলতে হচ্ছে, যা সৃজনশীল চর্চার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তেজগাঁও কলেজে কৃষ্ণকুমারী নাটকের মঞ্চায়ন | undefined

ভেঙে পড়ছে মধ্যবিত্ত শিল্পীদের জীবন

এই স্থবিরতার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন সেই মধ্যবিত্ত ও নবীন শিল্পীরা, যাঁরা শুধুমাত্র অভিনয়ের আয়ে নির্ভরশীল। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক অভিনয়শিল্পী বলেন, “আগে অন্তত মাসে দুটো নাটকে কাজ করতাম। এখন ৬ মাসেও কোনো ফোন আসে না। বাসাভাড়া, বাজার, ছেলেমেয়ের স্কুলের খরচ—সব মিলিয়ে একপ্রকার মরেই যাচ্ছি।”

অনেকে বিকল্প আয়ের পথ খুঁজছেন—কেউ অনলাইন পণ্য বিক্রি করছেন, কেউ স্কুলে নাট্যশিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। কেউ আবার অভিনয় ছেড়ে পুরোপুরি অন্য পেশায় চলে গেছেন।

শিল্পপতিরা নীরবসরকার উদাসীন

এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিগত সহায়তা, কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারপ্রধানের দিক থেকেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতি খাতের বরাদ্দ বরাবরের মতোই কম। প্রণোদনার ঘোষণা থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয়নি।

অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সভা বুধবার

অভিনয়শিল্পী সংঘের এক সদস্য বলেন, “আমরা চাই সরকার এই শিল্পের প্রতি সংবেদনশীল হোক। দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করতে হলে নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই হবে।”

কী হতে পারে উত্তরণ পথ?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সেন্সরবোর্ডের স্বাধীনতা, কর সুবিধা, বিজ্ঞাপনশিল্পে প্রণোদনা, নতুন নাট্য ও চলচ্চিত্র প্রকল্পে বিনিয়োগ, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সরকারি তদারকি এবং মৌলবাদী চাপমুক্ত সৃজনশীল পরিবেশ গড়ে তোলাই হতে পারে উত্তরণের পথ।

এছাড়া শিল্পীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা, বেকার ভাতা ও স্বাস্থ্যসেবার নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।

বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়েরও প্রতিফলন। এই শিল্পের পতন মানে একটি সমাজের সাংস্কৃতিক জড়তার প্রতিচ্ছবি। তাই শিল্পী ও কলাকুশলীদের পাশে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি। না হলে একদিন হয়তো আমরা এক নিঃসঙ্গ পর্দা দেখব—যেখানে শিল্প নেই, কণ্ঠ নেই, প্রতিবাদ নেই।

জনপ্রিয় সংবাদ

শিশুদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে চীনের সঙ্গে একই পথে হাঁটছে পশ্চিমা বিশ্ব

বাংলাদেশে নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পে স্থবিরতা: শতশত শিল্পী আয়হীন, সংকটে জীবন

০৫:২৬:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫

স্থবির শিল্পকষ্টে শিল্পীরা

গত এক বছরে বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পে নজিরবিহীন স্থবিরতা নেমে এসেছে। ছোটপর্দা ও বড়পর্দা—উভয় ক্ষেত্রেই নতুন প্রযোজনার সংখ্যা কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে নাটকের ধারাবাহিক ও একক পর্বের নির্মাণ, চলচ্চিত্রে নতুন চিত্রায়ণও কার্যত স্থগিত। এর ফলে শতশত শিল্পী কাজ না পেয়ে বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

অনেক জনপ্রিয় ও প্রতিশ্রুতিশীল অভিনয়শিল্পী গত এক বছরে মাত্র একটি বা দুটি কাজ পেয়েছেন, কেউ কেউ পুরো বছরেই একটিও প্রজেক্ট পাননি। আয় না থাকায় অনেক শিল্পী পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন, কেউ কেউ পেশা পরিবর্তনের চিন্তায়, কেউ মানসিক চাপের শিকার। কয়েকজন অভিজ্ঞ অভিনেতা জানিয়েছেন, ঘরভাড়াও সময়মতো পরিশোধ করতে পারছেন না।

প্রযোজনা কেন কমেছে?

নাট্যপ্রযোজক ও পরিচালক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, সামগ্রিক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, টেলিভিশন বিজ্ঞাপন আয় কমে যাওয়া, সেন্সরবোর্ড ও প্রশাসনিক জটিলতা, ইউটিউব ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগের অনীহা—সব মিলিয়ে প্রযোজকেরা নতুন কাজে নামতে আগ্রহ হারিয়েছেন।

চলচ্চিত্র প্রযোজনা ক্ষেত্রেও একই চিত্র। গত এক বছরে বাংলাদেশে বড় প্রযোজনা সংস্থাগুলোর কেউই উল্লেখযোগ্য কোনো ছবি শুরু করেনি। অনেক সিনেমার শুটিং মাঝপথে বন্ধ হয়েছে অর্থাভাবে।

অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং মূল্যস্ফীতি নাটক-চলচ্চিত্র শিল্পেও প্রভাব ফেলেছে। বিজ্ঞাপন খাতে খরচ কমিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। মিডিয়া হাউসগুলো কর্মী ছাঁটাই করছে, প্রযোজনা ব্যয় সংকুচিত করেছে।

এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাম্প্রতিক মৌলবাদী চাপের কারণে সমাজে একটি আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। অনেক নাট্যকার ও পরিচালক জানান, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর বিষয় এড়িয়ে চলতে হচ্ছে, যা সৃজনশীল চর্চার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তেজগাঁও কলেজে কৃষ্ণকুমারী নাটকের মঞ্চায়ন | undefined

ভেঙে পড়ছে মধ্যবিত্ত শিল্পীদের জীবন

এই স্থবিরতার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন সেই মধ্যবিত্ত ও নবীন শিল্পীরা, যাঁরা শুধুমাত্র অভিনয়ের আয়ে নির্ভরশীল। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক অভিনয়শিল্পী বলেন, “আগে অন্তত মাসে দুটো নাটকে কাজ করতাম। এখন ৬ মাসেও কোনো ফোন আসে না। বাসাভাড়া, বাজার, ছেলেমেয়ের স্কুলের খরচ—সব মিলিয়ে একপ্রকার মরেই যাচ্ছি।”

অনেকে বিকল্প আয়ের পথ খুঁজছেন—কেউ অনলাইন পণ্য বিক্রি করছেন, কেউ স্কুলে নাট্যশিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। কেউ আবার অভিনয় ছেড়ে পুরোপুরি অন্য পেশায় চলে গেছেন।

শিল্পপতিরা নীরবসরকার উদাসীন

এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিগত সহায়তা, কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সরকারপ্রধানের দিক থেকেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতি খাতের বরাদ্দ বরাবরের মতোই কম। প্রণোদনার ঘোষণা থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয়নি।

অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সভা বুধবার

অভিনয়শিল্পী সংঘের এক সদস্য বলেন, “আমরা চাই সরকার এই শিল্পের প্রতি সংবেদনশীল হোক। দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করতে হলে নাটক ও চলচ্চিত্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই হবে।”

কী হতে পারে উত্তরণ পথ?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সেন্সরবোর্ডের স্বাধীনতা, কর সুবিধা, বিজ্ঞাপনশিল্পে প্রণোদনা, নতুন নাট্য ও চলচ্চিত্র প্রকল্পে বিনিয়োগ, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সরকারি তদারকি এবং মৌলবাদী চাপমুক্ত সৃজনশীল পরিবেশ গড়ে তোলাই হতে পারে উত্তরণের পথ।

এছাড়া শিল্পীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা, বেকার ভাতা ও স্বাস্থ্যসেবার নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।

বাংলাদেশের নাটক ও চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়েরও প্রতিফলন। এই শিল্পের পতন মানে একটি সমাজের সাংস্কৃতিক জড়তার প্রতিচ্ছবি। তাই শিল্পী ও কলাকুশলীদের পাশে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি। না হলে একদিন হয়তো আমরা এক নিঃসঙ্গ পর্দা দেখব—যেখানে শিল্প নেই, কণ্ঠ নেই, প্রতিবাদ নেই।