১২:৩৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫

বাটার লোকসান: অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপর্যস্ত খুচরা বাজার

এক প্রতীকী ধস

২০২৫ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বাটা শু কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড প্রায় ৯.৭ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে। গত বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি লাভ করলেও এবার এমন ধস কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের সংকট নয়—এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ক্রমবর্ধমান ভোক্তা সংকোচনের প্রতিফলন। এই প্রতিবেদন বাটার ক্ষতির প্রেক্ষিতে দেশের খুচরা শিল্প, ভোক্তা আচরণ, অর্থনৈতিক নীতি, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর আলো ফেলে।

The fair value of the taka

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের আর্থিক বিশ্লেষণ

২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুন—এই তিন মাসে বাটা বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাদের বিক্রয় ৪০ শতাংশের বেশি হ্রাস পায়; আগের বছরের এই সময়ে যেখানে বিক্রয় ছিল ২৬২ কোটি টাকা, এবার তা নেমে এসেছে মাত্র ১৫৮ কোটিতে। এই বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, দোকানপাটে হামলা, সরবরাহব্যবস্থার ব্যাঘাত এবং ক্রয়ক্ষমতার পতন। বাটার ব্যবসায়িক মডেল মূলত খুচরা বিক্রয়ের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে অধিকাংশ খরচ স্থায়ী—যেমন কর্মচারীর বেতন, দোকান ভাড়া, ইউটিলিটি ও পরিচালন ব্যয়। বিক্রয় হ্রাস পাওয়ায় এই ব্যয় অনুপাতে বেড়ে গিয়ে কোম্পানিকে কার্যকর লোকসানের মুখে ফেলে।

এছাড়া নিট মুনাফা মার্জিনেও বড় রকমের পতন ঘটেছে। আগের বছর এটি ছিল ৭.২ শতাংশ, এবার তা দাঁড়িয়েছে নেতিবাচক ৬.১ শতাংশে। গ্রস মার্জিন ৩৮ শতাংশ থেকে কমে ২৫ শতাংশ হয়েছে এবং পরিচালন মার্জিন নেমে গেছে প্রায় -৮ শতাংশে। বিক্রয় প্রবৃদ্ধি যেখানে আগের বছর ছিল ৯ শতাংশ, এবার তা হয়েছে -৪০ শতাংশ। এই পরিস্থিতি কেবল বাটার নয়—সারা দেশের খুচরা খাতেরই এক গভীর ঝুঁকির প্রতিচ্ছবি।

কেএফসি' এবং 'বাটা'য় হামলা পরিকল্পিত? সমালোচনায় মুখর নেটিজেনরা!

রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়া

২০২৫ সালের শুরু থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। অবরোধ, হরতাল, বিক্ষোভ, এমনকি সহিংসতার কারণে খুচরা ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় দোকানপাটে হামলা ও লুটপাট হয়েছে, যার মধ্যে বাটার কয়েকটি আউটলেটও আক্রান্ত হয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর উপস্থিতির অভাবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহ দেখা দিয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম সীমিত করে ফেলেছে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা

দেশের চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে ১২ শতাংশের বেশি, সাধারণ মানুষের খরচের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এতে বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হ্রাস পেয়েছে—যেমন ফ্যাশন বা জুতা। ডলারের সংকট আমদানিকৃত কাঁচামালের ব্যয় বাড়িয়েছে। বাটা যেহেতু বহু উপকরণ বিদেশ থেকে আনে, তাই উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। একই সঙ্গে এলসি জটিলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য সময়মতো দেশে আনা সম্ভব হয়নি, যার প্রভাব পড়েছে বিক্রয়ে।

Bata showroom bashundhara city discount

খুচরা খাতের বিপর্যস্ত অবস্থা

বাংলাদেশের খুচরা খাত বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। মধ্যবিত্তের ব্যয়সীমা সংকুচিত এবং নিম্নবিত্ত কেবল নিত্যপ্রয়োজনেই সীমিত। ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস বিকল্প তৈরি করলেও বাটার মতো ফিজিক্যাল স্টোরনির্ভর ব্র্যান্ডগুলো বড় ধরনের চাপে পড়েছে। মূল্যছাড় এবং অফারের পরও ভোক্তা সাড়া কম। নতুন ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্রমবর্ধমান ভাড়া, কর, নিরাপত্তা এবং পরিচালন ব্যয়ের চাপে বিপন্ন।

মধ্যবিত্তের আস্থার প্রতীক

বাটা শুধুই একটি কোম্পানি নয়, এটি মধ্যবিত্ত বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও আস্থার প্রতীক। তাদের লোকসান আমাদের দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং ভোক্তা মনস্তত্ত্বের মিলিত সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এখনই যদি কার্যকর নীতিগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে শুধু বাটা নয়—বাংলাদেশের বহু খুচরা ব্যবসা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সময় এসেছে একটি সমন্বিত সংস্কারের, যার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

বাটার লোকসান: অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপর্যস্ত খুচরা বাজার

০২:৪৯:০৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

এক প্রতীকী ধস

২০২৫ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে বাটা শু কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড প্রায় ৯.৭ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ে। গত বছরের একই সময়ে কোম্পানিটি লাভ করলেও এবার এমন ধস কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের সংকট নয়—এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ক্রমবর্ধমান ভোক্তা সংকোচনের প্রতিফলন। এই প্রতিবেদন বাটার ক্ষতির প্রেক্ষিতে দেশের খুচরা শিল্প, ভোক্তা আচরণ, অর্থনৈতিক নীতি, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ওপর আলো ফেলে।

The fair value of the taka

দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের আর্থিক বিশ্লেষণ

২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুন—এই তিন মাসে বাটা বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাদের বিক্রয় ৪০ শতাংশের বেশি হ্রাস পায়; আগের বছরের এই সময়ে যেখানে বিক্রয় ছিল ২৬২ কোটি টাকা, এবার তা নেমে এসেছে মাত্র ১৫৮ কোটিতে। এই বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা, দোকানপাটে হামলা, সরবরাহব্যবস্থার ব্যাঘাত এবং ক্রয়ক্ষমতার পতন। বাটার ব্যবসায়িক মডেল মূলত খুচরা বিক্রয়ের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে অধিকাংশ খরচ স্থায়ী—যেমন কর্মচারীর বেতন, দোকান ভাড়া, ইউটিলিটি ও পরিচালন ব্যয়। বিক্রয় হ্রাস পাওয়ায় এই ব্যয় অনুপাতে বেড়ে গিয়ে কোম্পানিকে কার্যকর লোকসানের মুখে ফেলে।

এছাড়া নিট মুনাফা মার্জিনেও বড় রকমের পতন ঘটেছে। আগের বছর এটি ছিল ৭.২ শতাংশ, এবার তা দাঁড়িয়েছে নেতিবাচক ৬.১ শতাংশে। গ্রস মার্জিন ৩৮ শতাংশ থেকে কমে ২৫ শতাংশ হয়েছে এবং পরিচালন মার্জিন নেমে গেছে প্রায় -৮ শতাংশে। বিক্রয় প্রবৃদ্ধি যেখানে আগের বছর ছিল ৯ শতাংশ, এবার তা হয়েছে -৪০ শতাংশ। এই পরিস্থিতি কেবল বাটার নয়—সারা দেশের খুচরা খাতেরই এক গভীর ঝুঁকির প্রতিচ্ছবি।

কেএফসি' এবং 'বাটা'য় হামলা পরিকল্পিত? সমালোচনায় মুখর নেটিজেনরা!

রাজনৈতিক অস্থিরতার ছায়া

২০২৫ সালের শুরু থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়েছে। অবরোধ, হরতাল, বিক্ষোভ, এমনকি সহিংসতার কারণে খুচরা ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় দোকানপাটে হামলা ও লুটপাট হয়েছে, যার মধ্যে বাটার কয়েকটি আউটলেটও আক্রান্ত হয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর উপস্থিতির অভাবে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহ দেখা দিয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম সীমিত করে ফেলেছে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা

দেশের চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যে ১২ শতাংশের বেশি, সাধারণ মানুষের খরচের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। এতে বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হ্রাস পেয়েছে—যেমন ফ্যাশন বা জুতা। ডলারের সংকট আমদানিকৃত কাঁচামালের ব্যয় বাড়িয়েছে। বাটা যেহেতু বহু উপকরণ বিদেশ থেকে আনে, তাই উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। একই সঙ্গে এলসি জটিলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য সময়মতো দেশে আনা সম্ভব হয়নি, যার প্রভাব পড়েছে বিক্রয়ে।

Bata showroom bashundhara city discount

খুচরা খাতের বিপর্যস্ত অবস্থা

বাংলাদেশের খুচরা খাত বর্তমানে এক গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। মধ্যবিত্তের ব্যয়সীমা সংকুচিত এবং নিম্নবিত্ত কেবল নিত্যপ্রয়োজনেই সীমিত। ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস বিকল্প তৈরি করলেও বাটার মতো ফিজিক্যাল স্টোরনির্ভর ব্র্যান্ডগুলো বড় ধরনের চাপে পড়েছে। মূল্যছাড় এবং অফারের পরও ভোক্তা সাড়া কম। নতুন ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্রমবর্ধমান ভাড়া, কর, নিরাপত্তা এবং পরিচালন ব্যয়ের চাপে বিপন্ন।

মধ্যবিত্তের আস্থার প্রতীক

বাটা শুধুই একটি কোম্পানি নয়, এটি মধ্যবিত্ত বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও আস্থার প্রতীক। তাদের লোকসান আমাদের দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং ভোক্তা মনস্তত্ত্বের মিলিত সংকটের ইঙ্গিত দেয়। এখনই যদি কার্যকর নীতিগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে শুধু বাটা নয়—বাংলাদেশের বহু খুচরা ব্যবসা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। সময় এসেছে একটি সমন্বিত সংস্কারের, যার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।