বয়স বাড়লেও থেমে থাকার নয়
৭০ বছর বয়স সাধারণত জীবনের সেই সময়, যখন অধিকাংশ মানুষ কর্মজীবন থেকে অবসর নেন, দৈনন্দিন কাজকর্মে ধীর গতি আসে, আর স্মৃতিশক্তিও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু বয়স বাড়ার অর্থ এই নয় যে মস্তিষ্ক আর কাজের ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে যাবে। সামান্য জীবনযাপন পরিবর্তন, নিয়মিত অনুশীলন ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস একজন ৭০ বছর বয়সী মানুষকে স্মৃতিশক্তি ও কর্মক্ষমতায় আগের মতোই সচল করে রাখতে পারে।
মানসিক ব্যায়াম: মস্তিষ্কের জিম দরকার
মস্তিষ্ককে সচল রাখার জন্য যেমন শারীরিক ব্যায়াম দরকার শরীরের জন্য, তেমনই দরকার মানসিক ব্যায়াম। নিয়মিত ধাঁধা সমাধান, বই পড়া, নতুন ভাষা শেখার চেষ্টা, দাবা খেলা বা গণিত চর্চা—এসব মস্তিষ্কের নিউরনকে সক্রিয় রাখে। “নিউরোপ্লাস্টিসিটি” নামে পরিচিত এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত হয়েছে, বয়স যতই হোক, মস্তিষ্ক নতুন তথ্য শিখতে ও গ্রহণ করতে সক্ষম।
শারীরিক ব্যায়াম: রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, মস্তিষ্কে অক্সিজেন পৌঁছায়
প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা, হালকা যোগব্যায়াম, সাঁতার বা নরম ব্যায়াম বয়সের কারণে স্থবির হওয়া শরীর ও মনকে সক্রিয় করে তোলে। শরীরে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, ফলে মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছে যায় এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত হয়। শারীরিক কার্যকলাপ ডিমেনশিয়া ও অ্যালঝেইমার রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম: পুনর্জীবন দেয় মস্তিষ্ককে
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের গুণমান কমে যায়, যা মস্তিষ্কের তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতাকে দুর্বল করে। একজন ৭০ বছর বয়সী মানুষের প্রতিদিন অন্তত ৬–৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম প্রয়োজন। ঘুম মস্তিষ্ককে সারাদিনের ক্লান্তি থেকে পুনর্জীবিত করে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিগুলোকে সংগঠিত করে।
পরিপূর্ণ ও সুষম খাদ্য: স্মৃতিশক্তির জ্বালানি
মস্তিষ্কের জন্য উপকারী কিছু খাবার হলো:
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ (যেমন স্যামন,টুনা, রূপচাঁদা ও অনান্য সামুদ্রিক মাছ)
- বাদাম ও আখরোট
- সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল (বিশেষত ব্লুবেরি,কলা, আপেল)
- ডার্ক চকলেট ও গ্রিন টি (পরিমিত পরিমাণে)
- পর্যাপ্ত পানি
অতিরিক্ত চিনি, অতিরিক্ত লবণ এবং চর্বিযুক্ত খাবার স্মৃতিশক্তি দুর্বল করতে পারে। পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যাভ্যাস গঠন করা জরুরি।
সামাজিক সম্পৃক্ততা: একাকিত্ব থেকে বেরিয়ে আসা
একজন বৃদ্ধ মানুষ যদি পরিবার, বন্ধু বা প্রতিবেশীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তাহলে তার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। একাকিত্ব ও বিষণ্ণতা সরাসরি স্মৃতিশক্তি ও চিন্তার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সপ্তাহে অন্তত কয়েকদিন আড্ডা, ক্লাবের মিটিং, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া খুবই কার্যকর।
নতুন কিছু শেখা: বয়স কোনো বাধা নয়
৭০ বছরেও কেউ চাইলে কম্পিউটার চালাতে শিখতে পারেন, অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিতে পারেন, নতুন হস্তশিল্প রপ্ত করতে পারেন। নতুন কিছু শেখার মাধ্যমে মস্তিষ্কের কোষগুলো আগের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে স্মৃতি ও বুদ্ধিমত্তা বাড়ায়।
নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও চিকিৎসা সহায়তা গ্রহণ
বয়সের কারণে অনেক সময় থাইরয়েড সমস্যা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা নিউরোলজিক্যাল অসুস্থতা দেখা দেয়—যা স্মৃতিশক্তি ও শারীরিক সক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। তাই প্রতি ছয় মাস অন্তর রুটিন মেডিক্যাল চেকআপ করা উচিত। প্রয়োজনে নিউরোলজিস্ট বা গেরিয়াট্রিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
বয়স শুধু সংখ্যা, সচল থাকাটাই মুখ্য
৭০ বছর বয়সের পরে অনেকেই ভাবেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় শেষ। কিন্তু বাস্তব হলো—স্মৃতিশক্তি ও কর্মক্ষমতা ধরে রাখা বা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, যদি নিজের প্রতি মনোযোগী হওয়া যায়। নিয়মিত অনুশীলন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, ভালো খাদ্য ও মানসিক প্রশান্তি একজন বৃদ্ধ মানুষকেও তরুণের মতো কর্মক্ষম রাখে। স্মৃতিশক্তি হারানো ঠেকানো সম্ভব, যদি সচেতনতা ও প্রচেষ্টা থাকে।
শরীর ও মনের এই যৌথ যত্নেই নিহিত থাকে একজন ৭০ বছরের মানুষের প্রাণবন্ত ও কর্মময় জীবনের মূল চাবিকাঠি।