মনোযোগ হারানোর যুগে মনোযোগী হওয়ার গুরুত্ব
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত গতির যুগে আমরা প্রায়শই মনোযোগ হারিয়ে ফেলি। মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ভিডিও গেমস—সবকিছু যেন মনোযোগ কাড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এই পরিস্থিতিতে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা, কাজ, আত্মউন্নয়ন এবং পারিবারিক দায়িত্ববোধে মনোযোগী করে তোলা একটি চ্যালেঞ্জ। একইসঙ্গে বড়রাও কীভাবে নিজের জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখবেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ লেখায় তুলে ধরা হলো কীভাবে আমরা ও আমাদের কিশোর সন্তানরা একসাথে এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে পারি।
শিক্ষা: শুধুই পরীক্ষার জন্য নয়, আত্মগঠনের জন্য
শিক্ষাকে অনেকেই শুধুমাত্র পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে দেখে, অথচ আসল শিক্ষা হলো জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে চিন্তা, মানবিকতা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা। কিশোর সন্তানদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ জাগাতে চাই :
- জিজ্ঞাসু মন তৈরি করা:প্রশ্ন করতে শেখানো, বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করা, ক্লাসে শোনা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা।
- শেখার সঙ্গে আনন্দের সম্পর্ক:শিক্ষাকে কঠিন বোঝা মনে না করে, গল্প, চিত্র, প্রযুক্তি বা খেলার মাধ্যমে শেখা।
- অভিনন্দন ও অনুপ্রেরণা:সন্তান পড়ালেখায় মনোযোগ দিলে প্রশংসা করা। তারা ব্যর্থ হলেও পাশে থাকা।
অভিভাবকদেরও উচিত, প্রতিদিন সন্তানদের পড়াশোনার খোঁজ নেওয়া, পড়ার পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ‘তুমি পারো’ বলে আত্মবিশ্বাস জোগানো।
কর্মজীবনে মনোযোগ: দায়িত্ব, সময়জ্ঞান ও পেশাগত শৃঙ্খলা
কাজের প্রতি মনোযোগ শুধু একজনের নয়, পুরো পরিবারের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিশোর বয়স থেকেই যদি কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা যায়, ভবিষ্যতে তা পেশাগত সফলতার ভিত্তি হবে।
- ছোট কাজ দিয়ে শুরু:বাড়ির ছোট দায়িত্ব (জল দেওয়া, ঘর গোছানো) দিয়ে অভ্যাস তৈরি করা।
- সময়ের মূল্য শেখানো:ঘড়ির দিকে তাকিয়ে পরিকল্পনা করা, সময়মতো স্কুলে যাওয়া, সময়মতো খাওয়া-ঘুম।
- স্বপ্ন দেখার অনুপ্রেরণা দেওয়া:তারা কী হতে চায়, সেই ভবিষ্যতের পেশার ছবি দেখিয়ে অনুপ্রাণিত করা।
অভিভাবকদের উচিত নিজের কর্মশৃঙ্খলা বজায় রাখা, যাতে সন্তান তাদের দেখে শিখতে পারে।
আত্মউন্নয়ন: নিজের ভেতরেই লুকিয়ে আছে উন্নতির চাবিকাঠি
সফলতা ও আত্মবিশ্বাসের জন্য চাই আত্মউন্নয়ন। এটি শরীর, মন ও চরিত্রের বিকাশের একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।
- আত্মসমালোচনার ক্ষমতা:নিজের ভুল স্বীকার করা ও তা সংশোধনের চেষ্টা করা।
- নিয়মিত অভ্যাস তৈরি:যেমন, সকালে ঘুম থেকে ওঠা, বই পড়া, স্বাস্থ্যকর খাওয়া, ব্যায়াম করা।
- নিজস্ব আগ্রহে সময় দেওয়া:গান, আঁকা, রান্না, প্রোগ্রামিং—যা ভালো লাগে তা শিখতে উৎসাহ দেওয়া।
যতটা সম্ভব সন্তানদের স্বাধীনভাবে ভাবতে শেখানো উচিত। তাতে তারা আত্মবিশ্বাসী হবে, দায়িত্ব নিতে পারবে।
পরিবারে মনোযোগী হওয়া: ভালোবাসা ও দায়িত্বের বন্ধন
পরিবার হলো নিরাপত্তার কেন্দ্র। কিন্তু কিশোর বয়সে সন্তানদের অনেকেই পরিবার থেকে দূরে সরে যায়। এজন্য চাই :
- খোলা মনে কথা বলা:সন্তান যেন মনে করে, বাবা-মার সঙ্গে সে যেকোনো কথা বলতে পারে।
- একসাথে সময় কাটানো:প্রতিদিন অন্তত একবেলা একসঙ্গে খাওয়া, সপ্তাহে একদিন একসঙ্গে বাইরে যাওয়া।
- পারিবারিক সিদ্ধান্তে অংশ নেওয়া:কোন অনুষ্ঠান হবে, কোথায় ঘুরতে যাওয়া হবে—সন্তানদের মতামত নেওয়া।
এতে তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ বাড়বে এবং পরিবারের প্রতি ভালোবাসা গভীর হবে।
প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখা: মনোযোগের সবচেয়ে বড় বাধা
মোবাইল ফোন, টিকটক, গেম—এগুলো বর্তমান কিশোরদের মনোযোগ হরণের বড় মাধ্যম। তাই প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত ও সচেতনভাবে করাতে হবে।
নির্ধারিত সময়: পড়াশোনা ও খেলার সময় আলাদা করে দেওয়া, প্রযুক্তির সময়সীমা নির্ধারণ।
সহনীয় বিকল্প তৈরি: ট্যাব ব্যবহার না করে বিকেলে খেলাধুলার মতো বিকল্পে উৎসাহ দেওয়া।
সচেতনতা তৈরি: প্রযুক্তির ভালো ও খারাপ দুই দিক সম্পর্কে জানানো।
অভিভাবকরাও যদি দিনে নির্দিষ্ট সময়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, সন্তানদের জন্য তা আদর্শ হবে।
একসাথে এগিয়ে চলার শিক্ষা
শিক্ষা, কাজ, আত্মউন্নয়ন ও পারিবারিক দায়িত্ব—এই চারটি স্তম্ভ যদি আমরা নিজেরা চর্চা করি এবং কিশোর সন্তানদের উৎসাহ দিই, তবে একসাথে গড়ে উঠবে মনোযোগী, সচেতন এবং দায়িত্বশীল প্রজন্ম। পরিবারই হতে পারে সেই শক্ত ভিত্তি, যেখানে ভালোবাসা, শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের আলোয় একজন কিশোর মানুষ হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের এক সুনাগরিক।