০৮:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫

কোভিড পরবর্তী তরুণরা মানসিক রোগ নিয়ে আগের লজ্জা থেকে বেরিয়ে এসেছে  

এক মহামারির দীর্ঘ ছায়া

২০১৯ সালের শেষ প্রান্তে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারি এক অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের অধ্যায় খুলে দেয় সারা পৃথিবীর জন্য। স্কুল-কলেজ বন্ধ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, লকডাউন আর মৃত্যুর মিছিল—এসব মিলিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ঘিরে ফেলে এক মানসিক দোলাচল। প্রযুক্তিনির্ভরতা, সামাজিক দূরত্ব ও উদ্বেগের মিশেলে গঠিত হয় নতুন এক মানসিক অবস্থা। এই প্রতিবেদন সেই মানসিক পরিবর্তনগুলোর একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে।

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব

কোভিড-কালীন লকডাউন ও কোয়ারেন্টাইনের কারণে দীর্ঘদিন পরিবার, বন্ধু ও সহপাঠীদের ছাড়া থাকার ফলে অনেক তরুণ এক প্রকার সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। বিশেষ করে শহুরে তরুণদের মধ্যে এই অনুভূতি ছিল তীব্র। এতে করে মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে প্রভাব পড়ে। একাকীত্ব থেকে হতাশা, এমনকি ডিপ্রেশনের মতো সমস্যাও বাড়তে থাকে। অনেকেই জানান, তাঁরা আগের মতো সহজে সামাজিক হতে পারছেন না, ছোটখাটো ভিড়েও অস্বস্তি বোধ করছেন।

এডুটেক – Shetu

উদ্বেগ ও ভবিষ্যৎ ভীতি

মহামারির সময় কাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে। উচ্চশিক্ষার ছাত্রদের অনিশ্চয়তা, চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া তরুণদের দুশ্চিন্তা এবং ক্যারিয়ার পরিকল্পনার ভেঙে পড়া এই কাঠামো তরুণদের মনে এক গভীর উদ্বেগ তৈরি করে। বহু তরুণ-তরুণী জানিয়েছেন, তাঁরা এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সংশয়ে আছেন। “কিছুই নিশ্চিত না”—এই মন্ত্র যেন ছায়ার মতো তাঁদের চিন্তাজগতে ঘুরপাক খায়।

ডিজিটাল নির্ভরতা ও ভার্চুয়াল জীবনের সংকট

অনলাইন ক্লাস, ভার্চুয়াল মিটিং, সোশ্যাল মিডিয়া—এগুলো ছাড়া তরুণদের জীবন একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে কোভিডকালে। তবে এই অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা আবার নতুন এক ধরনের মানসিক ক্লান্তি সৃষ্টি করে, যাকে “ডিজিটাল ফ্যাটিগ (Digital Fatigue)” বলা হয়। পাশাপাশি বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ায় অনেক তরুণের মধ্যে বাস্তবতা ও ভার্চুয়াল বাস্তবতার বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভার্চুয়াল আত্মবিশ্বাস, কিন্তু বাস্তবে আত্মবিশ্বাসের অভাব।

মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় পরিবর্তন

একদিকে যেমন মানসিক চাপ বেড়েছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। আগে যেখানে মানসিক রোগ নিয়ে কথা বলা ছিল ‘ট্যাবু (নিষিদ্ধ বিষয়)’, এখন অনেকেই খোলাখুলি বিষণ্ণতা, উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা নিয়ে কথা বলছেন। কিছু তরুণ থেরাপি গ্রহণ করছেন, মাইন্ডফুলনেস বা মেডিটেশন অভ্যাস করছেন, আবার কেউ কেউ নিজেদের মানসিক সুস্থতা রক্ষার জন্য নতুন শখ, সৃজনশীল চর্চা বা ব্যায়াম শুরু করেছেন।

মূল্যবোধ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

মহামারির অভিঘাতে তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেকেই চাকরি বা উচ্চবিত্ত জীবন নয়, বরং মানসিক শান্তি, পরিবার ও জীবনের অর্থপূর্ণতা খোঁজার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন, কেউ আবার পরিবেশবান্ধব জীবনের খোঁজে ব্যস্ত।

সম্পর্কের টানাপোড়েন | জেনে নিন এর পেছনের ৩টি কারণ

সম্পর্কের গতিধারায় নতুন রূপ

বন্ধুত্ব, প্রেম ও পারিবারিক সম্পর্কে দূরত্ব, ভুল বোঝাবুঝি এবং কিছু ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ হয়েছে। আবার কেউ কেউ এই সময়ে পরিবারকে নতুন করে চিনেছেন, কাছাকাছি এসেছেন। প্রেম ও বিয়ের সম্পর্কেও এক ধরনের বাস্তবতা এসেছে—অনেকেই এখন দ্রুত বন্ধনে না জড়িয়ে মানসিক প্রস্তুতির দিকে ঝুঁকছেন।

নতুন এক মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা

তরুণ প্রজন্ম এখন এমন এক যুগে দাঁড়িয়ে, যেখানে অতীতের অনিশ্চয়তা আর বর্তমানের চ্যালেঞ্জ হাত ধরাধরি করে চলছে। কোভিড-১৯ শুধু শরীর নয়, মনকেও প্রভাবিত করেছে, আর তার রেশ আজও আছে। তবে এর মধ্যেই গড়ে উঠছে এক নতুন মনস্তত্ত্ব—যেখানে মানসিক সুস্থতা, আত্মজ্ঞান ও সঠিক ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা দৃশ্যমান।

এই পরিবর্তনগুলো একদিকে যেমন উদ্বেগের কারণ, তেমনি একটি আত্মসচেতন, মননশীল প্রজন্ম গঠনের দিকেও ইঙ্গিত করছে। মহামারির ছায়া থেকে উঠে এসে তরুণরা যদি এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে এটি হতে পারে এক যুগান্তকারী মানসিক জাগরণের শুরু।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

কোভিড পরবর্তী তরুণরা মানসিক রোগ নিয়ে আগের লজ্জা থেকে বেরিয়ে এসেছে  

০৬:২৪:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১ অগাস্ট ২০২৫

এক মহামারির দীর্ঘ ছায়া

২০১৯ সালের শেষ প্রান্তে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারি এক অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের অধ্যায় খুলে দেয় সারা পৃথিবীর জন্য। স্কুল-কলেজ বন্ধ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, লকডাউন আর মৃত্যুর মিছিল—এসব মিলিয়ে তরুণ প্রজন্মকে ঘিরে ফেলে এক মানসিক দোলাচল। প্রযুক্তিনির্ভরতা, সামাজিক দূরত্ব ও উদ্বেগের মিশেলে গঠিত হয় নতুন এক মানসিক অবস্থা। এই প্রতিবেদন সেই মানসিক পরিবর্তনগুলোর একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে।

একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব

কোভিড-কালীন লকডাউন ও কোয়ারেন্টাইনের কারণে দীর্ঘদিন পরিবার, বন্ধু ও সহপাঠীদের ছাড়া থাকার ফলে অনেক তরুণ এক প্রকার সামাজিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। বিশেষ করে শহুরে তরুণদের মধ্যে এই অনুভূতি ছিল তীব্র। এতে করে মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে প্রভাব পড়ে। একাকীত্ব থেকে হতাশা, এমনকি ডিপ্রেশনের মতো সমস্যাও বাড়তে থাকে। অনেকেই জানান, তাঁরা আগের মতো সহজে সামাজিক হতে পারছেন না, ছোটখাটো ভিড়েও অস্বস্তি বোধ করছেন।

এডুটেক – Shetu

উদ্বেগ ও ভবিষ্যৎ ভীতি

মহামারির সময় কাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়ে। উচ্চশিক্ষার ছাত্রদের অনিশ্চয়তা, চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া তরুণদের দুশ্চিন্তা এবং ক্যারিয়ার পরিকল্পনার ভেঙে পড়া এই কাঠামো তরুণদের মনে এক গভীর উদ্বেগ তৈরি করে। বহু তরুণ-তরুণী জানিয়েছেন, তাঁরা এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সংশয়ে আছেন। “কিছুই নিশ্চিত না”—এই মন্ত্র যেন ছায়ার মতো তাঁদের চিন্তাজগতে ঘুরপাক খায়।

ডিজিটাল নির্ভরতা ও ভার্চুয়াল জীবনের সংকট

অনলাইন ক্লাস, ভার্চুয়াল মিটিং, সোশ্যাল মিডিয়া—এগুলো ছাড়া তরুণদের জীবন একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে কোভিডকালে। তবে এই অতিরিক্ত প্রযুক্তিনির্ভরতা আবার নতুন এক ধরনের মানসিক ক্লান্তি সৃষ্টি করে, যাকে “ডিজিটাল ফ্যাটিগ (Digital Fatigue)” বলা হয়। পাশাপাশি বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ায় অনেক তরুণের মধ্যে বাস্তবতা ও ভার্চুয়াল বাস্তবতার বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় ভার্চুয়াল আত্মবিশ্বাস, কিন্তু বাস্তবে আত্মবিশ্বাসের অভাব।

মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতায় পরিবর্তন

একদিকে যেমন মানসিক চাপ বেড়েছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। আগে যেখানে মানসিক রোগ নিয়ে কথা বলা ছিল ‘ট্যাবু (নিষিদ্ধ বিষয়)’, এখন অনেকেই খোলাখুলি বিষণ্ণতা, উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা নিয়ে কথা বলছেন। কিছু তরুণ থেরাপি গ্রহণ করছেন, মাইন্ডফুলনেস বা মেডিটেশন অভ্যাস করছেন, আবার কেউ কেউ নিজেদের মানসিক সুস্থতা রক্ষার জন্য নতুন শখ, সৃজনশীল চর্চা বা ব্যায়াম শুরু করেছেন।

মূল্যবোধ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

মহামারির অভিঘাতে তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেকেই চাকরি বা উচ্চবিত্ত জীবন নয়, বরং মানসিক শান্তি, পরিবার ও জীবনের অর্থপূর্ণতা খোঁজার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন, কেউ আবার পরিবেশবান্ধব জীবনের খোঁজে ব্যস্ত।

সম্পর্কের টানাপোড়েন | জেনে নিন এর পেছনের ৩টি কারণ

সম্পর্কের গতিধারায় নতুন রূপ

বন্ধুত্ব, প্রেম ও পারিবারিক সম্পর্কে দূরত্ব, ভুল বোঝাবুঝি এবং কিছু ক্ষেত্রে বিচ্ছেদ হয়েছে। আবার কেউ কেউ এই সময়ে পরিবারকে নতুন করে চিনেছেন, কাছাকাছি এসেছেন। প্রেম ও বিয়ের সম্পর্কেও এক ধরনের বাস্তবতা এসেছে—অনেকেই এখন দ্রুত বন্ধনে না জড়িয়ে মানসিক প্রস্তুতির দিকে ঝুঁকছেন।

নতুন এক মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা

তরুণ প্রজন্ম এখন এমন এক যুগে দাঁড়িয়ে, যেখানে অতীতের অনিশ্চয়তা আর বর্তমানের চ্যালেঞ্জ হাত ধরাধরি করে চলছে। কোভিড-১৯ শুধু শরীর নয়, মনকেও প্রভাবিত করেছে, আর তার রেশ আজও আছে। তবে এর মধ্যেই গড়ে উঠছে এক নতুন মনস্তত্ত্ব—যেখানে মানসিক সুস্থতা, আত্মজ্ঞান ও সঠিক ভারসাম্য খোঁজার চেষ্টা দৃশ্যমান।

এই পরিবর্তনগুলো একদিকে যেমন উদ্বেগের কারণ, তেমনি একটি আত্মসচেতন, মননশীল প্রজন্ম গঠনের দিকেও ইঙ্গিত করছে। মহামারির ছায়া থেকে উঠে এসে তরুণরা যদি এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে এটি হতে পারে এক যুগান্তকারী মানসিক জাগরণের শুরু।