ব্যাটিং স্টাইল: চোখ ধাঁধানো শট নির্বাচন ও টেকনিক্যাল পরিপক্বতা
লিটন দাসকে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা চেনেন একজন ‘ক্লাসি’ ব্যাটসম্যান হিসেবে। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং স্টাইল মূলত চোখ জুড়ানো কাভার ড্রাইভ, নিখুঁত টাইমিং এবং ফ্লুইড ফুটওয়ার্কের জন্য খ্যাত। তাঁর ব্যাটিংয়ে কঠোরতা কম, সৌন্দর্য বেশি। বল অফ-স্ট্যাম্পের বাইরেই হোক কিংবা শর্ট-পিচ, লিটনের ব্যাট থেকে বেরিয়ে আসে সময়োপযোগী, শৈল্পিক শট। তিনি স্পিন ও পেস উভয় বোলিংয়ের বিরুদ্ধেই সাবলীল এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাওয়ার হিটিংয়েও নিজেকে অনেকটা তৈরি করে তুলেছেন।
তাঁর ব্যাটিংয়ের আরেকটি বড় দিক হলো আত্মবিশ্বাস। একবার যখন সেট হন, তখন যেকোনো বোলিং আক্রমণকে শাসন করার সামর্থ্য রাখেন। লিটন ধৈর্য এবং আগ্রাসনের মাঝামাঝি ব্যালান্স বজায় রেখে ইনিংস গড়েন, যা তাঁকে অন্যান্য ওপেনারদের চেয়ে আলাদা করে তোলে।
করাচিতে সেঞ্চুরি: টেস্ট ক্রিকেটে লিটনের পরিপক্বতা
২০২১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে করাচি টেস্টে লিটন দাস তাঁর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেন। ১৪৪ রানের এই ইনিংসটি ছিল চাপে খেলা এক অসাধারণ কীর্তি। শুরুতে উইকেট পড়ছিল একের পর এক, তবে লিটন মিডল অর্ডারে নেমে পরিস্থিতি সামাল দেন। অফ ড্রাইভ, ব্যাকফুট পাঞ্চ এবং সুইপ শটের নিখুঁত সংমিশ্রণে তিনি বোঝান, যে টেস্ট ক্রিকেটেও তাঁর আলাদা জাত আছে।
এই ইনিংসটি শুধু ব্যক্তিগত মাইলফলকই ছিল না, বরং বাংলাদেশের টেস্ট ব্যাটিংয়ের পরিপক্বতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৭৬ রানের ইনিংস: ওয়ানডে ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া এক মহাকাব্য
২০২১ সালে জিম্বাবুয়ের হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে লিটন দাস খেলেন তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস—১৭৬ রান। এটি বাংলাদেশের হয়ে তৎকালীন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান। ইনিংসজুড়ে ছিল ১৬টি চার ও ১টি ছয়। তিনি শুরুর ধীর গতিকে কৌশলে সামলে এক সময় ইনিংসটিকে রূপ দেন মারমুখী ইনিংসে।
এই ইনিংসের মাধ্যমে লিটন প্রমাণ করেন, তাঁর মধ্যে বড় ইনিংস খেলার ধৈর্য ও টেম্পারমেন্ট দুই-ই রয়েছে। ইনিংসটি দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে ক্লাসিক ব্যাটিংয়ের একটি উদাহরণ হিসেবে স্থান পায়।
ভারতের বিপক্ষে মিরপুরে ৭৩ বলে ১২৬: টি-টোয়েন্টিতে আগুন ঝরানো রূপ
২০১৯ সালে দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে লিটন দাস ৭৩ বলে ১২৬ রানের এক বিস্ফোরক ইনিংস খেলেন। যদিও ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে সংক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং এটি অনানুষ্ঠানিক টি-টোয়েন্টি হিসাবে বিবেচিত হয়, তবুও ইনিংসটি তাঁর টি-টোয়েন্টি সামর্থ্যের চমৎকার এক প্রতিফলন।
উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, ইনিংসটিতে লিটনের ব্যাট থেকে আসে ৭টি ছয় ও ১৩টি চার। বিশেষ করে ভারতের বোলারদের বিপক্ষে তাঁর আত্মবিশ্বাস ও স্কোরিং রেট ছিল দুর্দান্ত। এই ইনিংস লিটনকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ওপেনার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
এশিয়া কাপে ৬০ বলে ৮৯: বড় ম্যাচে ধৈর্য ও আগ্রাসনের মিশেল
২০১৮ সালের এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে লিটন দাস খেলেন ৮৯ রানের এক ঝলমলে ইনিংস। ৬০ বলের এই ইনিংসে ছিল ৭টি চার ও ২টি ছয়। কঠিন পরিস্থিতিতে দলকে ভালো শুরু এনে দেন লিটন, যা ফাইনালের উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে যায়, তবে লিটনের ব্যাটিং ছিল অনেক বেশি প্রশংসিত। এটি ছিল বড় ম্যাচে তাঁর মানসিক দৃঢ়তার একটি বড় উদাহরণ।
স্টাইল ও ধৈর্যের প্রতীক
লিটন দাস বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক নতুন ঘরানার ব্যাটসম্যান। তাঁর ইনিংসগুলো শুধু রান নয়, চোখের আনন্দও দেয়। একদিকে যখন পাওয়ার হিটিংয়ের যুগ চলছে, তখন লিটনের ব্যাটিংয়ে যেন দেখা মেলে ব্যাটসম্যানশিপের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য। ভবিষ্যতে এই ব্যাটসম্যান বাংলাদেশের হয়ে আরও অনেক মহাকাব্যিক ইনিংস উপহার দেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা দেশের কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর।