সংকটের ঘেরাটোপে দেশের অর্থনীতি
বাংলাদেশ বর্তমানে এমন এক বহুমুখী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছে,যা একসাথে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, আয়ের স্থবিরতা এবং ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তার মতো একাধিক চাপ সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন, জ্বালানি খাতের সংকট, এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মিলেমিশে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই চাপ শুধু স্বল্পমেয়াদে নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে দেশের সামাজিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত শহর ও শহরতলির নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং গ্রামীণ কৃষকরা এখন এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি, যেখানে দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোই হয়ে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
শহরে নিম্ন-মধ্যবিত্তের সংগ্রাম: ব্যয়ের ভারে ন্যুব্জ
ঢাকার মতো বড় শহরে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাপন এখন এক কঠিন সমীকরণে পরিণত হয়েছে। আয় যেমন আগের তুলনায় খুব বেশি বাড়েনি, ব্যয়ের চাপ তেমনই বহুগুণে বেড়েছে।
খাদ্যের ব্যয়
প্রতিদিনের নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। চালের কেজি ৭০–৭৫ টাকা, ডালের কেজি ১৫০ টাকার ওপরে, আর মাছ-মাংসের দাম একেবারেই হাতের বাইরে। গৃহিণী রোজিনা আক্তার বললেন, “আগে মাসে একবার গরুর মাংস রান্না করতাম, এখন তিন মাসেও একবার হয় না। বাজারে গেলে মনে হয় আমরা অন্য এক জগতে বাস করছি।”
বাসাভাড়া ও ইউটিলিটি বিল
ভাড়ার চাপও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই বছরে ঢাকার ভাড়া গড়ে ১৫–২০ শতাংশ বেড়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিলও সমানতালে বেড়েছে। এখন একটি পরিবারের মাসিক আয়ের অর্ধেকেরও বেশি খরচ হচ্ছে শুধুমাত্র বাসাভাড়া ও ইউটিলিটি বিলে।
মধ্যবিত্তের নীরব কষ্ট: মর্যাদা রক্ষা ও বাস্তবতার ফাঁদ
মধ্যবিত্ত শ্রেণি সরাসরি অভিযোগ না করলেও, তাদের ভেতরের চাপ দিন দিন বাড়ছে। তারা মর্যাদা রক্ষার চেষ্টায় অনেক প্রয়োজনীয় খরচও বাদ দিচ্ছে।
সন্তানের শিক্ষা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন, বই, কোচিং ফি—সব মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে পড়াতে মাসে কয়েক হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। শিক্ষক বাবা কামরুল ইসলাম বলেন, “নিজের সন্তানের ভালো পড়াশোনা করাতে এখন নিজের পোশাক-জুতো কেনাও বাদ দিতে হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা বন্ধ করাও তো সম্ভব নয়।”
সামাজিক অনুষ্ঠান
আগে আত্মীয়-স্বজনের বিয়ে বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ছিল আনন্দের বিষয়, কিন্তু এখন তা বাড়তি খরচের বোঝা। অনেকে বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে সরাসরি না গিয়ে ‘ব্যস্ততা’ বা ‘অসুস্থতার’ অজুহাত দেখাচ্ছেন।
গ্রামীণ কৃষকের জীবন: উৎপাদন বাড়িয়েও ক্ষতির মুখে
গ্রামীণ কৃষকরা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে আছেন যেখানে উৎপাদন বাড়লেও লাভ হচ্ছে না।
উৎপাদন খরচ ও বাজার মূল্য
সার, বীজ ও কীটনাশকের দাম গত বছরে ৩০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু ধান, পাট বা সবজির দাম বাজারে সেই অনুপাতে বাড়েনি। কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, “যত খরচ করি, বাজারে তত দাম পাই না। ফসল বেচে ঋণ শোধ করতেই হিমশিম খেতে হয়।”
প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব
বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হওয়া এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা। সরকারি সহায়তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ করছেন কৃষকরা। অনেকেই বাধ্য হয়ে ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছেন।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা: দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি
অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজুর রহমান মনে করেন, “এখনকার সংকট শুধু দ্রব্যমূল্য নয়, বরং আয়ের স্থবিরতা, কর্মসংস্থানের অভাব এবং বাজারের অস্থিরতার সম্মিলিত ফল। যদি দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, আগামী বছরগুলোতে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে।”
তিনি কৃষক ও শহুরে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ ভর্তুকি এবং বাজারে পাইকারি–খুচরা দামের ফারাক কমানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
ভুক্তভোগীদের গল্প: বাস্তব জীবনের কষ্ট
শহরের বাসিন্দা শামীম আক্তার
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন, কিন্তু ছয় মাস আগে চাকরি হারিয়েছেন। এখন অনলাইনে ছোট ব্যবসা করছেন, কিন্তু আয় আগের অর্ধেক। “আগে যেখানে তিনবেলার খাবারে মাছ-মাংস থাকত, এখন সপ্তাহে একদিনও হয় না,” তিনি আক্ষেপ করলেন।
গ্রামীণ কৃষক মনিরুল ইসলাম
তিন একর জমিতে ধান চাষ করেও লোকসান গুনতে হয়েছে। “এভাবে চলতে থাকলে জমি বেচে অন্য কাজ খুঁজতে হবে,”—বললেন তিনি।
এক অনিশ্চিত আগামী
বর্তমান মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা শুধু অর্থনীতিকে নয়, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। শহরের নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত, গ্রামীণ কৃষক—সবাই এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সহজ পথ নেই।