বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরেই স্থিতিশীলতার সংকটে রয়েছে। কখনো হঠাৎ সূচক বেড়ে যায়, আবার অল্প সময়েই ধসে পড়ে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
প্রথমত, শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। অনেক সময় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রভাব, অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁস (insider trading), এবং কৃত্রিমভাবে শেয়ার দরের উত্থান-পতন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে শেয়ারবাজার এখনো শিল্পায়ন ও বহুমুখী বিনিয়োগের অভাবে সংকীর্ণ। ব্যাংক, বীমা এবং কিছু সীমিত সংখ্যক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শেয়ার বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে। ফলে বাজারে বৈচিত্র্য কম এবং স্থিতিশীলতাও আসছে না।
তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব এবং সরকারি নীতি-সহায়তায় ঘাটতি থাকার কারণে শেয়ারবাজার আস্থার জায়গা হয়ে উঠতে পারেনি। অনেক সাধারণ মানুষ একে এখনও “জুয়া খেলার জায়গা” হিসেবে দেখে।
তৈরি পোশাক খাত ও শেয়ারবাজার
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ভিত্তি তৈরি পোশাক শিল্প। এটি জিডিপি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বর্তমানে প্রায় ৮৪% রপ্তানি আয় আসে তৈরি পোশাক থেকে।
যদি তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেন, তবে এর ইতিবাচক দিক হতে পারে—
- • শেয়ারবাজারে বড় ও স্থিতিশীল কোম্পানি যুক্ত হবে।
- • সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে।
- • বাজারে তারল্য বাড়বে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও শক্তিশালী হবে।
ফলে বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার সুযোগ পাবে।
এটি কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এখনকার পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্পপতিদের জন্য শেয়ারবাজারে বড় আকারে বিনিয়োগ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
একদিকে, তাদের প্রবেশ বাজারকে শক্তিশালী করতে পারে। অন্যদিকে, বাজারের বর্তমান অস্থিরতা এবং স্বচ্ছতার ঘাটতি তাদের বিনিয়োগকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা মূলত রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক বাজারে অর্ডার কমে যাওয়া, মূল্যস্ফীতি বা মন্দা দেখা দিলে তাদের পুঁজিও সংকটে পড়তে পারে।
তাই সরাসরি বড় অঙ্কের বিনিয়োগের আগে শেয়ারবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সংস্কার, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর পদক্ষেপ জরুরি।
বাংলাদেশের শেয়ারবাজার স্থিতিশীল নয় মূলত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, সীমিত শিল্প বৈচিত্র্য এবং নীতি-সহায়তার ঘাটতির কারণে। তৈরি পোশাক শিল্পপতিদের বিনিয়োগ বাজারকে ইতিবাচকভাবে বদলাতে পারে, তবে বর্তমান পরিস্থিতি পুরোপুরি অনুকূল নয়। সঠিক সংস্কার ছাড়া তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
অতএব, প্রথমে শেয়ারবাজারকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও বহুমুখী করতে হবে। এরপর পোশাক শিল্পপতি কিংবা অন্যান্য বড় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বাজারকে সত্যিকার অর্থে স্থিতিশীল করে তুলতে পারবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, “আমরা চাই শেয়ারবাজার হোক মূলধন গঠনের আসল জায়গা। এখানে যদি স্বচ্ছতা ও আস্থা তৈরি হয়, তাহলে তৈরি পোশাক খাতসহ দেশের অন্যান্য বড় শিল্পপতিরা নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করবেন। এতে শুধু বাজার নয়, পুরো অর্থনীতিই লাভবান হবে। তবে বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আমাদের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আগে বাজারকে টেকসই করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”