১০:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঢাকার বাজারে বেগুনের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি

ঢাকার রান্নাঘরের বাজারে প্রতিদিনের ক্রেতাদের সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে বেগুনের দাম। যে বেগুন এক সময় সাধারণ মানুষ সহজেই কিনতে পারত, এখন তা অনেকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেগুনের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।

মৌসুমি প্রভাব

বেগুন একটি মৌসুমি সবজি। বর্ষাকালে নিয়মিত বৃষ্টিপাত ও অনিয়মিত আবহাওয়া গাছের বৃদ্ধি ও ফলনকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেক সময় অতিবৃষ্টি কিংবা পানি জমে থাকার কারণে চাষিদের বাগান নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে উৎপাদন কমে এবং বাজারে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়, যা দামের ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণ।

উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি

সার, কীটনাশক ও শ্রমের দাম বাড়ায় কৃষকদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ডিজেল ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে গ্রাম থেকে ঢাকায় সবজি আনতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। এই অতিরিক্ত ব্যয় সরাসরি বাজারে বেগুনের খুচরা মূল্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।

ভেজাল সার-বীজে সয়লাব সৈয়দপুরের বাজার

সরবরাহ চেইনের সংকট

ঢাকার বাজারে সরবরাহ চেইন দীর্ঘ ও জটিল। কৃষক থেকে আড়তদার, পাইকার, তারপর খুচরা ব্যবসায়ী—প্রতিটি ধাপে দামের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এছাড়া বাজারে একচেটিয়া ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে—কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে।

বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ

সম্প্রতি দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় বন্যা দেখা দেওয়ায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এই পরিস্থিতি সবজি উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা তাদের পণ্য ঢাকায় সরবরাহ করতে পারছেন না, ফলে বাজারে বেগুনসহ অন্যান্য সবজির সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে।

ভোক্তার ভোগান্তি

বেগুন সাধারণত প্রতিদিনের রান্নায় ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় সবজি। ইলিশ মৌসুমে বেগুন-ভর্তা ও ভাজির চাহিদা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু দাম বাড়ায় অনেক পরিবার এই সাধারণ সবজিটি কিনতে দ্বিধাবোধ করছে। খুচরা বাজারে বেগুনের দাম কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় পৌঁছানোয় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নওগাঁয় ডাব বেগুনের পরীক্ষামূলক চাষ

মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা

কৃষকের কণ্ঠ

রাজবাড়ীর এক কৃষক আবদুল হাকিম বললেন:
“আমাদের মাঠে এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে অনেক গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। আবার কীটনাশক ও সারের দাম আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। খরচ মেটাতে গিয়ে উৎপাদন কমে গেছে। আমরা আসলে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না, বাজারে যারা দালালি করে তারাই লাভ করছে।”

ক্রেতার অভিজ্ঞতা

ঢাকার শ্যামবাজারে সবজি কিনতে আসা গৃহিণী রওশন আরা বললেন:
“আগে সপ্তাহে দু’দিন দেড় কেজি বেগুন কিনতাম। এখন দাম এত বেশি যে এক কেজিও কিনতে ভয় লাগে। প্রতিদিনের তরকারির বাজার করতে গিয়ে বাজেট ভেঙে যাচ্ছে।”

আরেকজন চাকরিজীবী ক্রেতা কামরুল হাসান বললেন:
“আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ, সবজি ছাড়া সংসার চলে না। অথচ বাজারে ঢুকে মনে হয় সবজি আর সোনার দামে বিক্রি হচ্ছে।”

রাতের কারওয়ান বাজার - banglanews24.com

ব্যবসায়ীর বক্তব্য

ঢাকার কারওয়ান বাজারের এক খুচরা ব্যবসায়ী মনির হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান:
“আমরা আসলে আড়ত থেকে যে দামে কিনি, সেই দামের ওপর সামান্য লাভ রেখে বিক্রি করি। কিন্তু আড়তেই দামের নিয়ন্ত্রণ নেই। পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। ফলে আমাদের হাতে কিছু করার নেই।”

আড়তদারের প্রতিক্রিয়া

শ্যামবাজারের এক আড়তদার সেলিম উদ্দিনের দাবি:
“আমাদের ওপর সিন্ডিকেটের দোষ চাপানো হয়, কিন্তু বাস্তবে সমস্যা উৎপাদন ও সরবরাহে। গ্রামে এখন যথেষ্ট বেগুন নেই। যে জিনিস বাজারে কম পাওয়া যায়, তার দাম তো বাড়বেই। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ নিচ্ছে, সেটি অস্বীকার করছি না।”

সালথায় এবার ১১৮ বিঘা জমিতে বেগুনের চাষ করেছেন কৃষকরা

সমাধানের পথ

 কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে সরাসরি বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিবহন খরচ কমাতে সরকারি উদ্যোগে সহায়তা প্রয়োজন।
বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নজরদারি ও সিন্ডিকেট দমনে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।
চাষিদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা বাড়িয়ে বেগুন উৎপাদনের বিকল্প উৎস নিশ্চিত করা জরুরি।

ঢাকায় বেগুনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কোনো একক কারণে নয়; বরং মৌসুমি প্রভাব, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, সরবরাহ সংকট এবং ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া মনোভাব মিলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কৃষক, ক্রেতা, ব্যবসায়ী ও আড়তদার—সবাই স্বীকার করছে সমস্যার গভীরতা। এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে।

ঢাকার বাজারে বেগুনের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি

০৬:৫১:০৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৫

ঢাকার রান্নাঘরের বাজারে প্রতিদিনের ক্রেতাদের সবচেয়ে বড় আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে বেগুনের দাম। যে বেগুন এক সময় সাধারণ মানুষ সহজেই কিনতে পারত, এখন তা অনেকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেগুনের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, যা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।

মৌসুমি প্রভাব

বেগুন একটি মৌসুমি সবজি। বর্ষাকালে নিয়মিত বৃষ্টিপাত ও অনিয়মিত আবহাওয়া গাছের বৃদ্ধি ও ফলনকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেক সময় অতিবৃষ্টি কিংবা পানি জমে থাকার কারণে চাষিদের বাগান নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে উৎপাদন কমে এবং বাজারে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়, যা দামের ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণ।

উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি

সার, কীটনাশক ও শ্রমের দাম বাড়ায় কৃষকদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ডিজেল ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে গ্রাম থেকে ঢাকায় সবজি আনতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। এই অতিরিক্ত ব্যয় সরাসরি বাজারে বেগুনের খুচরা মূল্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।

ভেজাল সার-বীজে সয়লাব সৈয়দপুরের বাজার

সরবরাহ চেইনের সংকট

ঢাকার বাজারে সরবরাহ চেইন দীর্ঘ ও জটিল। কৃষক থেকে আড়তদার, পাইকার, তারপর খুচরা ব্যবসায়ী—প্রতিটি ধাপে দামের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। এছাড়া বাজারে একচেটিয়া ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে—কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে।

বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ

সম্প্রতি দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় বন্যা দেখা দেওয়ায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এই পরিস্থিতি সবজি উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা তাদের পণ্য ঢাকায় সরবরাহ করতে পারছেন না, ফলে বাজারে বেগুনসহ অন্যান্য সবজির সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে।

ভোক্তার ভোগান্তি

বেগুন সাধারণত প্রতিদিনের রান্নায় ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় সবজি। ইলিশ মৌসুমে বেগুন-ভর্তা ও ভাজির চাহিদা আরও বেড়ে যায়। কিন্তু দাম বাড়ায় অনেক পরিবার এই সাধারণ সবজিটি কিনতে দ্বিধাবোধ করছে। খুচরা বাজারে বেগুনের দাম কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় পৌঁছানোয় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

নওগাঁয় ডাব বেগুনের পরীক্ষামূলক চাষ

মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা

কৃষকের কণ্ঠ

রাজবাড়ীর এক কৃষক আবদুল হাকিম বললেন:
“আমাদের মাঠে এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে অনেক গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। আবার কীটনাশক ও সারের দাম আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। খরচ মেটাতে গিয়ে উৎপাদন কমে গেছে। আমরা আসলে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না, বাজারে যারা দালালি করে তারাই লাভ করছে।”

ক্রেতার অভিজ্ঞতা

ঢাকার শ্যামবাজারে সবজি কিনতে আসা গৃহিণী রওশন আরা বললেন:
“আগে সপ্তাহে দু’দিন দেড় কেজি বেগুন কিনতাম। এখন দাম এত বেশি যে এক কেজিও কিনতে ভয় লাগে। প্রতিদিনের তরকারির বাজার করতে গিয়ে বাজেট ভেঙে যাচ্ছে।”

আরেকজন চাকরিজীবী ক্রেতা কামরুল হাসান বললেন:
“আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ, সবজি ছাড়া সংসার চলে না। অথচ বাজারে ঢুকে মনে হয় সবজি আর সোনার দামে বিক্রি হচ্ছে।”

রাতের কারওয়ান বাজার - banglanews24.com

ব্যবসায়ীর বক্তব্য

ঢাকার কারওয়ান বাজারের এক খুচরা ব্যবসায়ী মনির হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান:
“আমরা আসলে আড়ত থেকে যে দামে কিনি, সেই দামের ওপর সামান্য লাভ রেখে বিক্রি করি। কিন্তু আড়তেই দামের নিয়ন্ত্রণ নেই। পরিবহন খরচও বেড়ে গেছে। ফলে আমাদের হাতে কিছু করার নেই।”

আড়তদারের প্রতিক্রিয়া

শ্যামবাজারের এক আড়তদার সেলিম উদ্দিনের দাবি:
“আমাদের ওপর সিন্ডিকেটের দোষ চাপানো হয়, কিন্তু বাস্তবে সমস্যা উৎপাদন ও সরবরাহে। গ্রামে এখন যথেষ্ট বেগুন নেই। যে জিনিস বাজারে কম পাওয়া যায়, তার দাম তো বাড়বেই। তবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সুযোগ নিচ্ছে, সেটি অস্বীকার করছি না।”

সালথায় এবার ১১৮ বিঘা জমিতে বেগুনের চাষ করেছেন কৃষকরা

সমাধানের পথ

 কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে সরাসরি বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিবহন খরচ কমাতে সরকারি উদ্যোগে সহায়তা প্রয়োজন।
বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নজরদারি ও সিন্ডিকেট দমনে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।
চাষিদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা বাড়িয়ে বেগুন উৎপাদনের বিকল্প উৎস নিশ্চিত করা জরুরি।

ঢাকায় বেগুনের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কোনো একক কারণে নয়; বরং মৌসুমি প্রভাব, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, সরবরাহ সংকট এবং ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া মনোভাব মিলেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মাঠপর্যায়ের কৃষক, ক্রেতা, ব্যবসায়ী ও আড়তদার—সবাই স্বীকার করছে সমস্যার গভীরতা। এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে।