বাংলাদেশের বনাঞ্চলে জন্মানো গর্জন গাছ শুধু কাঠের জন্যই মূল্যবান নয়, এর বাকল বহু শতাব্দী ধরে আয়ুর্বেদিক ও লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম Dipterocarpus turbinatus। প্রাচীন চিকিৎসক থেকে শুরু করে আধুনিক গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে যে গর্জন গাছের বাকলে রয়েছে বহু রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা। এতে উপস্থিত জীবাণুনাশক, প্রদাহনাশক ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান মানবদেহের নানা অসুখ সারাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
গর্জন বাকলের প্রাকৃতিক উপাদান
গর্জন গাছের বাকলে প্রচুর পরিমাণে ট্যানিন, ফ্ল্যাভোনয়েড, এসেনশিয়াল অয়েল এবং প্রাকৃতিক রেজিন থাকে। এগুলো মানবদেহের ভেতর ও বাইরে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। পাশাপাশি প্রদাহ ও ব্যথা কমায় এবং ক্ষত দ্রুত শুকাতে সহায়তা করে।
কোন কোন রোগে কার্যকর
১. অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও ক্ষত
গর্জন বাকলের গুঁড়ো ক্ষতস্থানে ব্যবহার করলে রক্তপাত দ্রুত বন্ধ হয় এবং ক্ষত শুকিয়ে যায়।
২. ডায়রিয়া ও আমাশয়
লোকজ চিকিৎসায় গর্জন বাকল সিদ্ধ পানি পান করালে পেটের সংক্রমণজনিত ডায়রিয়া, আমাশয় ও হজম সমস্যায় আরাম পাওয়া যায়।
৩. শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি
বাকল থেকে তৈরি ওষুধ শ্বাসকষ্ট কমাতে সাহায্য করে। প্রাচীনকালে হাঁপানি রোগীদের জন্য গর্জন বাকলের ক্বাথ খাওয়ানো হতো।
৪. জ্বর ও সর্দি-কাশি
বাকলের ভেষজ উপাদান জ্বর কমায় ও শ্বাসনালী পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। কাশি, কফ জমা, গলাব্যথার প্রতিকারেও এটি কার্যকর।
৫. প্রদাহ ও ব্যথা
গর্জন বাকলের পেস্ট শরীরের ফোলা অংশে লাগালে প্রদাহ কমে যায় এবং ব্যথা হ্রাস পায়।
৬. ত্বকের রোগ
একজিমা, ঘা, ফোঁড়া ও চর্মরোগ নিরাময়ে গর্জন বাকল বহুল ব্যবহৃত। এর অ্যান্টি-ফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য ছত্রাকজনিত সংক্রমণ সারাতে সাহায্য করে।
৭. দাঁতের সমস্যা
প্রাচীন গ্রামীণ সমাজে গর্জন বাকলের গুঁড়ো দাঁতের ক্ষয়, মাড়ি ফোলা ও মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে ব্যবহার হতো।
৮. অন্ত্রের কৃমি
শিশুদের অন্ত্রে কৃমি হলে গর্জন বাকলের ভেষজ নির্যাস খাওয়ানো হতো। এটি প্রাকৃতিক কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে।
৯. লিভার ও পাকস্থলীর অসুখ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গর্জন বাকল লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক এবং পাকস্থলীর আলসার নিরাময়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
চিকিৎসাবিদ্যার দৃষ্টিতে গুরুত্ব
আধুনিক ভেষজ ওষুধ প্রস্তুতকারীরা গর্জন গাছের বাকল থেকে অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, হারবাল সিরাপ ও প্রাকৃতিক সাপ্লিমেন্ট তৈরি করছেন। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই এটিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সতর্কতা
যদিও গর্জন বাকল বহু রোগে কার্যকর, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সরাসরি ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করলে বমি, ডায়রিয়া বা অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
প্রকৃতির এক অমূল্য দান
গর্জন গাছের বাকল প্রকৃতির এক অমূল্য দান। এটি রক্তক্ষরণ, ডায়রিয়া, হাঁপানি, সর্দি-কাশি, প্রদাহ, ত্বকের সংক্রমণ, দাঁতের ব্যথা, কৃমি, এমনকি লিভারজনিত সমস্যার মতো ন্যূনতম নয়টি গুরুতর রোগের প্রতিকারে কাজে লাগে। লোকজ চিকিৎসা ও আধুনিক গবেষণা একত্রে প্রমাণ করছে যে, সঠিক ব্যবহার হলে গর্জন বাকল হতে পারে মানবদেহের জন্য এক কার্যকর ভেষজ ওষুধ। এ বিষয়ে আধুনিক গবেষণায় আরও অগ্রগতি ঘটছে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্জন বাকল থেকে ভবিষ্যতে নতুন প্রাকৃতিক ওষুধ আবিষ্কারের সম্ভাবনাও রয়েছে।