গত কয়েকদিন শোক দিবসে ডিজে পার্টি, সোশ্যাল মিডিয়া ভরা শোক প্রকাশ, রিকশাওলা ফ্যাসিস্ট হিসাবে গ্রেফতার হওয়া, ৩শ ফুটের হাঁসের মাংস, বিলাসবহুল হোটেলের নাস্তা—এই সবই শুধু মানুষের মুখে মুখে শুনিয়াছি।
এই বয়সে আসিয়া এইসব শুনিয়া খুব বেশি কান ও শরীর নড়িয়া চড়িয়া ওঠে না। এই জীবন ও এই দেশের ওপর দিয়া বহু জলস্রোত বহিয়া যাইতে দেখিয়াছি। আর এই সব জলস্রোত দেখিলে সব সময় একবারের এক বন্যাকালীন সাভারের বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কথা মনে পড়িয়া যায়। তিনি হয়তো আর পৃথিবীতে নাই। হয়তো বলিলাম কারণ, দৈবাৎ তো আছে। তবে এখন বাঁচিয়া থাকিতে হইলে তাহাকে একশ ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সী হইতে হইবে।
তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, চাচা আপনি আপনার জীবনে এমন বন্যা কি কখনও দেখিয়াছেন। তিনি উত্তর দিয়াছিলেন, তুমি বাপু বন্যা কোথায় দেখিতে পাইতেছো। তাহার উত্তরে বলিলাম, এই যে সব বাড়ি ঘর পানিতে ডুবিয়া গিয়াছে। তিনি বিরক্ত মুখে বলিলেন, নদীর চড়ায় ঘর বাঁধিলে বর্ষাকালে কি পানিতে ডুবিবে না আগুনে পুড়িবে?
জীবনে এমন সত্য, প্লেটো হইতে শুরু করিয়া মার্কস, রাসেল, রামমোহন বা রবীন্দ্রনাথ পড়িয়াও জানিতে পারি নাই। ইহার পর হইতে জীবন জীবনের মতো চলিয়া যায় কিন্তু কোনো কিছুই খুব বেশি নাড়া দেয় নাই। বুঝি চড়ায় যখন ঘর তখন এমন জল তো বহিয়াই যাইবে ঘরের ওপর দিয়া—ইহাতে আশ্চর্য হইবার কী বা থাকিতে পারে!
তবুও মাঝে মাঝে কিছু কথা যে কানের ভেতর বাজিয়া ওঠে না তাহা নয়।
সকালে হাঁটিতে আমার কখনও ভালো লাগে না। ভোরের বাতাসের থেকে দুপুরের তীব্র রোদে হাঁটিতে অনেক বেশি ভালো লাগে আমার কাছে। ইহা লইয়া ছোটবেলা হইতে বন্ধু-বান্ধবরা অনেক ঠাট্টা করিয়াছে। তাহাদের কখনও কিছু বলি নাই।

সকাল ও বিকেলের শান্ত সময়টি আমার পড়িবার বা যথাসামান্য লিখিবার জন্য অনেক বেশি ভালো লাগে। তাই যাহা একান্তই আমার—তাহা লইয়া বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কথা বাড়াইয়া সময় নষ্ট করিবার চাহিতে তাহাদের ব্যঙ্গ শোনা অনেক বেশি সুখকর মনে করিয়াছি জীবন ভরিয়া।
আজ সকালে কেন যে তাহার ব্যত্যয় ঘটিল তাহা বুঝিতে পারিলাম না। রোজকার রুটিনের মতো রাত দুইটার পরে ঘুমাইয়া সাড়ে ছয়টার দিকে উঠিয়া সাতটার কিছু পরে পড়িতে না বসিয়া মনে হইল একটু খোলা বাতাসে হাঁটিয়া আসি। আকাশ সকালেই মুখ ভার করিয়া ছিল, রাস্তাকে সদ্য স্নান শেষের গ্রামের নদীকূলের নারীর মতো দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, সে ভোর রাতে অনেক বেশি বৃষ্টির জলে স্নান করিয়াছে।
মনে মনে ভাবিলাম ভোরে বাহির হইয়া তো লাভই হইল। অনেকটা ফাঁকা রাস্তায় এমন একটি শান্ত আবহাওয়া দেখিতে পাইলাম। আর একটু পরেই তো মানুষের শরীরে শরীরে ধাক্কা খাইয়া ফুটপাতগুলো চলিবে আর রাস্তাগুলো ভরিয়া উঠিবে নানান মডেলের গাড়িতে।
যাহাই হোক বেশি দূর হাঁটা হইল না। অনভ্যাসের ফোঁটা কপালে চড় চড় করিয়া থাকে। তাই রাস্তার পাশে দুইটি ভ্যানে শাকসবজি দেখিয়া সেখানে দাঁড়াইয়া পড়িলাম। মনে মনে ভাবিলাম কিছু শাকসবজি বাজার করিয়া বাসায় লইয়া গিয়া একটু চমক লাগাইয়া দেই না কেন?
দুই প্রজাতির বেগুন ছিল ভ্যানে—একটির কেজি দুই শত টাকা, অন্যটি দুই শত পঞ্চাশ টাকা চাইছিল। জানিতে চাইছিলাম পটল ও করলা কত করিয়া। দোকানি একটু বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন স্যার, এগুলো তো গত এক সপ্তাহ ধরে একশ বিশ টাকা করে কেজি চলছে।”
অনেকক্ষণ বেগুনের দিকে চাহিয়া থাকিয়া শ্রদ্ধেয় শুধু নয়, পথপ্রদর্শক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ষাটের দশকের লেখার সেই বিখ্যাত লাইন মনে পড়িয়া গেল, “বাজারে গিয়া খাসির দামে মুরগি কিনিয়া আনিলাম।” প্রাতঃস্মরণীয় মানিক মিয়ার কথা মনে করিয়া ভাবিতে লাগিলাম, যাহারা বেগুন কিনিতেছেন, তাহারা নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবিতেছেন, “বাজারে গিয়া মুরগির দামে বেগুন কিনিয়া আনিলাম।”

সর্বশেষ শস্তা খুঁজিবার জন্য শাপলার আঁটির দাম করিলাম, তাহাও চল্লিশ টাকা। বুঝিলাম, জাতীয় ফুল শাপলার দণ্ডটি যাহা খুব প্রচলিত খাদ্য নয়। শুনিয়াছি, মন্বন্তরের কালে মানুষ ইহা সিদ্ধ করিয়া খাইতো। যাহোক সেও রাজধানীর বাজারে এমন দামী অবস্থান লইয়াছে—এ উন্নয়ন ভালোই লাগিল।
এমন সময় প্রভাতের হাঁটা শেষ করিয়া বছর পঞ্চাশ বয়স হইবে এমন এক তরুণ আসিয়া আমার পাশে দাঁড়াইল। তাহার মুখের দাঁড়িতে ও মাথার চুলে অল্প পাক ধরিয়াছে। তাহার মুহূর্তের আচরণ দেখিয়া বড়ই সদালাপী ও পরোপকারী মনে হইল। নিজ হাতে সবজি বাছিয়া অপরিচিত আমাকে কিছু বাজার করিতে সাহায্য করিল।
কিন্তু প্রতিটি সবজির দাম শুনিয়া একটু চমকিয়া যাইতেছি দেখিয়া, সে আরো ঘনিষ্ঠ হইয়া বলিল, “স্যার, বাজারে এসব সবজির দাম কেজি প্রতি আরো পাঁচ-সাত টাকা করে বেশি। এরা অনেক কম লাভ করে। রোদের মধ্যে শুকিয়ে যায় তাই রোদ বাড়ার আগেই কম লাভে বিক্রি করে।”
দোকানি তাহার কথা শুনিতে পাইয়া বলিল, “শুধু কম লাভটা দেখলেন, মালামাল যে অর্ধেক আনতেছি তাহা দেখলেন না।” সদালাপী মানুষটি বলিলেন, “কেন অর্ধেক আনছেন?” দোকানি বলিলেন, ওই যে দেখলেন না, ওই ভদ্রমহিলা শুধু দুই আঁটি শাক নিয়ে চলে গেলেন। মিষ্টি কুমড়ার ফালিটিও কিনলেন না।”
তখন সদালাপী ও পরোপকারী মানুষটি কারো কাছে আসিয়া বলিলেন, “স্যার, গতকাল ৮শ টাকার বাজার করেছি, একটি ব্যাগে এতটুকুই হয়েছে। অথচ বেতন তো বাড়ছে না। আমাদের মতো যারা নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করি, স্যার আমরা কীভাবে বাঁচব?”
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 



















