আফগানিস্তানে ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার চার বছর পর, পাকিস্তানের জন্য যে ভূরাজনৈতিক ‘জয়’ নিয়ে আশাবাদ দেখা গিয়েছিল, তা উবে গেছে।
কাবুল পতনের এক মাস আগে, ২০২১ সালের জুলাইয়ে ইসলামাবাদভিত্তিক একটি নিরাপত্তা থিংক-ট্যাঙ্কের সাকুল্যে বৈঠকে আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞ, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকেরা মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মধ্যে আফগানিস্তানে তালেবানের দ্রুত অগ্রগতির সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করেন।
অনেক অংশগ্রহণকারী তখন সৃষ্ট নিরাপত্তাশূন্যতা ও তার প্রভাব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তুললেও, কয়েকজন স্পষ্ট আশাবাদী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক সাবেক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, “ভালো সময় ফিরছে। কাবুলের দিল্লিমুখী সেটআপ বিদায় নিচ্ছে। তালেবান ক্ষমতায় ফিরলে ইসলামাবাদ শুধু পূর্ব আফগানিস্তানে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়স্থল বন্ধের জন্য চাপ দিলেই চলবে—তালেবান রাজি হবে। তারা আমাদের কাছে ঋণী।”
তিনি একা ছিলেন না। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা অভিজাতদের বড় অংশই ২০২১ সালের আগস্টে তালেবানের প্রত্যাবর্তনকে সতর্ক আশার দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন। কাবুলে ‘বন্ধুসুলভ’ শাসন কৌশলগত বহু পুরোনো লক্ষ্যে সহায়ক—ভারতীয় প্রভাব ঠেকানো, পশ্চিমা উপস্থিতি কমানো, এবং আঞ্চলিক ফল নির্ধারণে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একে বলেছিলেন “দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙা” মুহূর্ত। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশীদ আহমেদ তোর্খাম সীমান্তে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসে ‘এক নতুন জোট’ গঠনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যা নাকি অঞ্চলকে বৈশ্বিক মঞ্চে উঁচুতে তুলবে। এমনকি তৎকালীন বিরোধী রাজনীতিক, বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফও তালেবান নেতা মুল্লা বরাদরের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, “তোমাদের হাতে শক্তি থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহ আমাদের সঙ্গে। আল্লাহু আকবর।”
চার বছর পর সেই উচ্ছ্বাস মিলিয়ে গেছে। কাবুলে তালেবান শাসনকে ঘিরে যে ‘জিওপলিটিক্যাল জয়’ ধারণা করা হয়েছিল, সেটি আজ পাকিস্তানের জন্য উল্টো বোঝা। খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে বেলুচিস্তান পর্যন্ত জঙ্গি সহিংসতার নতুন ঢেউ মোকাবিলা করছে পাকিস্তান, যার বিস্তার ভেতরভাগেও ছড়িয়ে পড়ার হুমকি দিচ্ছে। এখন ইসলামাবাদ কি তার আফগান কৌশল পুনর্বিবেচনা করবে?
আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক শিরোনাম থেকে সরে গেলেও, ‘কৌশলগত জয়’-এর মূল্য পাকিস্তানের সামনে বাড়তেই থেকেছে। পশ্চিম সীমান্ত সুরক্ষিত করার বদলে ইসলামাবাদকে আজ জঙ্গি সহিংসতার পুনরুত্থান, খারাপতর নিরাপত্তা পরিবেশ এবং একসময়কার ‘মিত্র’ শাসনের সঙ্গে টানাপোড়েন সামলাতে হচ্ছে।
দুই দেশে সাম্প্রতিক ক্ষেত্রসমীক্ষার ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন দেখায়, তালেবানের প্রত্যাবর্তন পাকিস্তানের অন্তর্দেশীয় নিরাপত্তা সংকটকে কীভাবে গভীর করেছে এবং দীর্ঘদিনের কৌশলগত অনুমানের সীমাবদ্ধতা উন্মোচন করেছে।

সীমান্ত পেরিয়ে আবারও সহিংসতা বাড়ছে
আফগানিস্তানসীমান্তবর্তী বাজাউরের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রবীণদের কাছে পরিস্থিতি ছিল অতি গুরুতর। জেলা জুড়ে টিটিপি ও ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ (আইএসকেপি)—আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্টেট নেটওয়ার্কের স্থানীয় শাখা—বিরুদ্ধে নতুন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের প্রস্তুতি চলছিল। তাঁরা জিরগার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নেন।
টিটিপি কমান্ডারদের কাছে তাঁদের অনুরোধ ছিল সহজ: আফগানিস্তানে ফিরে যান, অথবা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সরে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করুন—গ্রামে যে ধ্বংস, বাস্তুচ্যুতি ও ভয়ের দাগ রেখে যায়, তা যেন সাধারণ মানুষকে না ভোগাতে হয়।
কিন্তু সময়ের পালাবদল টের পেয়ে জঙ্গিরা অস্বীকার করে।
আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়ে উজ্জীবিত টিটিপি নেতৃত্ব—জিরগায় উপস্থিত এক অংশগ্রহণকারীর ভাষায়—এমন শর্ত তোলে, যা পাকিস্তানের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। আলোচনা ভেঙে যায়; নতুন সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১১ আগস্ট অভিযান শুরু হয়।
কাবুলে তালেবানের ট্রায়াম্ফ পাকিস্তানের পশ্চিম বেল্টজুড়ে জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে সাহস জুগিয়েছে। টিটিপির পাশাপাশি খাইবার পাখতুনখোয়ার হাফিজ গুল বাহাদুর গোষ্ঠী এবং বেলুচিস্তানের বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) প্রভৃতি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন বদলাতে থাকা আঞ্চলিক ভারসাম্যকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী বিদ্রোহ জোরদার করেছে।
যে আইএসকেপি একসময় যুক্তরাষ্ট্র, পূর্বতন আফগান সরকার ও তালেবানের চাপে দুর্বল ছিল, তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবানের চাপে পড়ে সংগঠনটির কিছু যোদ্ধা পাকিস্তানে, বিশেষত বাজাউরে, সরে আসে—এবং এরপর সেখানেই একাধিক উচ্চপ্রোফাইল হামলা চালায়।
মার্চে বেলুচিস্তানে বিএলএ-র ‘জাফর এক্সপ্রেস’ যাত্রীবাহী ট্রেন ছিনতাইচেষ্টার সঙ্গে পড়েছিল ‘ইন্সটিটিউট ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড পিস’-এর গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স (জিটিআই) প্রকাশ। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেড়ে নেয়।
জিটিআই অনুযায়ী, পাকিস্তান এখন বুরকিনা ফাসোর পর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক সন্ত্রাসপ্রভাবিত দেশ। প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে উদ্বেগজনক বাস্তবতা—টিটিপি, বিএলএ ও আইএসকেপি—পাকিস্তানের এই তিন জঙ্গি সংগঠন বিশ্বের ১০টি সবচেয়ে প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী সংগঠনের মধ্যে রয়েছে; যা পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী কৌশলের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ।
জিটিআই-এর পর্যবেক্ষণ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও অন্যান্য নিরাপত্তা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান মেলালেও দেখা যায়—২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ তীব্রভাবে বেড়েছে। এরপরের বছরগুলোতে আত্মঘাতী হামলা, লক্ষ্যভিত্তিক হত্যাকাণ্ড, সামরিক স্থাপনা, রাজনৈতিক সমাবেশ ও মসজিদে জটিল আক্রমণ—সবকিছুই বেড়েছে।

উগ্রবাদী গোষ্ঠীর পুনরুত্থান
২০২০ সাল পর্যন্ত টিটিপি ও হাফিজ গুল বাহাদুর গোষ্ঠীর মতো সংগঠনগুলো একাধিক দিক থেকে চাপে ছিল। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ‘অপারেশন জার্ব-ই-আজব’সহ পাকিস্তানের বৃহৎ সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে তাদের বড় ক্ষতি হয়। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তাদের দুর্বল করে, আর মার্কিন ড্রোন হামলায় শীর্ষ নেতৃত্বের বড় অংশ নিহত হয়। ওই সময় বহু টিটিপি উপগোষ্ঠী স্তিমিত হয়ে যায় অথবা আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চল—খোস্ট, কুনার, নাঙ্গারহারে—বিচ্ছিন্নভাবে সরে যায়।
বেলুচিস্তানেও বিএলএসহ বড় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর হামলা দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা দমনপীড়ন ও অন্তর্দ্বন্দ্বে কমে আসে।
কিন্তু দোহায় যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান শান্তি আলোচনা ও পরবর্তী মার্কিন প্রত্যাহার পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর, বিশেষত টিটিপির, মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। তালেবানের সম্ভাব্য জয়ের পূর্বাভাসেই আগে বিচ্ছিন্ন থাকা টিটিপির দলগুলো একের পর এক আবার একীভূত হতে থাকে।
২০২০ সালের মাঝামাঝি, আল-কায়েদামুখী কয়েকটি ধারা-সহ বহু উপগোষ্ঠী টিটিপি প্রধান মুফতি নূর ওয়ালির নেতৃত্বে পুনরায় এক ছাতার নিচে আসে। অভ্যন্তরীণ বার্তায় ওয়ালি আফগান তালেবানের ঐক্যের প্রশংসা করে পাকিস্তানি জিহাদি গোষ্ঠীগুলোকে সেই পথ অনুসরণের আহ্বান জানান—“আফগান ভাইদের মতো সবাই এক পতাকার নিচে না এলে পাকিস্তানে জিহাদ সফল হবে না।”
২০২১ সালের আগস্টে তালেবানের পূর্ণ ক্ষমতায় ফেরা আঞ্চলিক জঙ্গি মতাদর্শীদের জন্য জলবিভাজিকা। টিটিপির কাছে এটি অনুপ্রেরণা, একইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের বৈধতা নিশ্চিত করা এক মুহূর্ত।
এর পর থেকে পাকিস্তানে বিদ্রোহী সহিংসতা তীক্ষ্ণভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সালে সন্ত্রাসী হামলা আগের বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেড়ে ৫২১-এ দাঁড়ায়। এতে নিহত হয়েছে ৮৫২ জন—মৃত্যু ২৩ শতাংশ বেশি—‘পাক ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ’-এর হিসাবে। ২০২১-এর পর টানা চার বছর ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণ ও হতাহতের ধারাবাহিক বৃদ্ধি এভাবে ধরা পড়ে।
আফগানিস্তানে ‘সহনশীল পরিবেশ’
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দাবি করেছে, আফগানিস্তান থেকে বেলুচিস্তানের ঝোব জেলায় অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় দুটি পৃথক অভিযানে ৪৭ জঙ্গিকে হত্যা করা হয়েছে—সীমান্তপারের সাম্প্রতিকতম ও সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংঘর্ষগুলোর একটি। সেনাবাহিনী বিস্তারিত জানায়নি; তবে ‘ফিতনা আল-খাওয়ারিজ’ নামের ব্যানারে—যা টিটিপি ও অন্যান্য ইসলামপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠীকে বোঝাতে সামরিক নেতৃত্বের দেওয়া অভিহিতকরণ—তাদের চিহ্নিত করেছে।
এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলেও এক অস্থির আফগানিস্তান রেখে গেছে, যা আঞ্চলিক জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্য আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। মতাদর্শগত আত্মবিশ্বাস হোক, পড়ে থাকা মার্কিন অস্ত্রে প্রবেশাধিকার হোক বা নিরাপদ আশ্রয়—তালেবান প্রশাসনের সক্রিয় সহায়তা বা নীরব মদদে এসব গোষ্ঠী সুবিধা পাচ্ছে।”
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশ্লেষণাত্মক সহায়তা ও নিষেধাজ্ঞা পর্যবেক্ষণ দলের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে একই আশঙ্কা উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের ‘সহনশীল পরিবেশে’ টিটিপির প্রায় ৬,০০০ যোদ্ধা আছে এবং তারা উন্নত অস্ত্র পেয়েছে—যা তাদের অপারেশনাল সক্ষমতা বাড়িয়েছে—এবং ‘ডি ফ্যাক্টো’ আফগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য লজিস্টিক ও কৌশলগত সহায়তা পাচ্ছে।

লাহোরভিত্তিক সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ, একাডেমিক মোহাম্মদ ফাইয়াজের ভাষ্য, তালেবানের প্রত্যাবর্তন পাকিস্তানের জন্য “খরচসাপেক্ষ” হয়েছে। “ক্ষমতা দখলের আগে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের অস্তিত্বগত কোনো হুমকি ছিল না। এখন তালেবানশাসিত আফগানিস্তান সেটি তৈরি করেছে,” তিনি বলেন। তাঁর মতে, তালেবান প্রশাসন টিটিপিকে পাকিস্তানের প্রাক্তন উপজাতীয় বেল্ট পুনর্দখলের প্রচেষ্টায় সক্রিয়ভাবে জোগান দিচ্ছে—যা একটি ‘সীমান্তছাড়া ইসলামি আমিরাত’ দৃষ্টিভঙ্গির অংশ।
২০১৪-র ‘অপারেশন জার্ব-ই-আজব’-এ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দেখিয়েছিল, জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলোকে কীভাবে গভীর আঘাত করা যায়। কিন্তু আজকের নিরাপত্তা বাস্তবতা মৌলিকভাবে আলাদা—আরও বিচ্ছিন্ন, জটিল, এবং ‘নির্ণায়ক’ পদক্ষেপের পক্ষে অনেক কম সহায়ক। ২০২১-পরবর্তী পাকিস্তানের রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা আফগানিস্তানে তালেবানের প্রত্যাবর্তনের নাটকীয় পরিবর্তনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
সিঙ্গাপুরের এস. রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ আবদুল বাসিতের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগ, তালেবানের সঙ্গে টানাপোড়েন, টিটিপিকে ঘিরে ভিন্ন অবস্থান এবং আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় রাষ্ট্রসমাজের ফাঁক—এসব কারণেই টিটিপি, হাফিজ গুল বাহাদুর গোষ্ঠীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিসন্ত্রাস কৌশল পাকিস্তান গড়ে তুলতে পারেনি।
রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, ভাঙা ঐকমত্য
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে খাইবার পাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী আলী আমিন গান্ধাপুর অশান্ত রাজনৈতিক ঢেউ পাড়ি দিচ্ছেন। সাবেক উপজাতীয় জেলার জিরগা নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান শুনেছেন—নতুন কোনো সামরিক অভিযান নয়, কারণ তাতে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ঘটবে। প্রবীণেরা বদলে একটি সর্বাত্মক, ক্ষমতাসম্পন্ন জিরগা—কেন্দ্র-প্রদেশের প্রতিনিধি, প্রবীণ ও অংশীজনদের নিয়ে—গঠন করে সরাসরি কাবুলের তালেবান প্রশাসনের সঙ্গে সংলাপের প্রস্তাব দেন।
নিজ দল থেকেও গান্ধাপুর চাপের মুখে। কারাগার থেকে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান বিশেষত একীভূত সাবেক উপজাতীয় জেলাগুলোতে সামরিক পদক্ষেপের অনুমোদনের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। দলের অবস্থান পরিষ্কার—নিজভূমিতে নতুন অভিযান নয়।
এ দৃশ্য ২০১৪ সালের চিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত, যখন করাচি বিমানবন্দর হামলা এবং আর্মি পাবলিক স্কুল (এপিএস) হত্যাকাণ্ড দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলে—‘অপারেশন জার্ব-ই-আজব’-এর পক্ষে। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম—সকলেই তখন একসুরে ছিল।
আজ পিটিআই, জমিয়তে উলেমা-ই-ইসলাম (জেইইউআই-এফ), আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি)—প্রধান প্রধান দলই নতুন অভিযানের বিরোধিতা করছে—বলে দিচ্ছে, এতে গণউচ্ছেদ ও সামাজিক সংকট বাড়বে। খাইবার পাখতুনখোয়ায় তৃণমূল শান্তি আন্দোলনের জোয়ারও বাড়ছে; যা ইঙ্গিত দেয়, রাজনৈতিক ঐক্যমত ছাড়া রাষ্ট্রের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন। ২০০৮ সাল থেকে নানা নামে বহু অভিযান চালানো হয়েছে; কিন্তু শান্তি ফেরেনি, সন্ত্রাসও নির্মূল হয়নি—স্থানীয় কর্মীরা বলেন।

সীমান্তপারের আশ্রয়কেন্দ্র
দশ বছর আগে টিটিপি অন্তর্দ্বন্দ্ব, আইএসকেপিতে পালিয়ে যাওয়া এবং মার্কিন ড্রোনে শীর্ষ নেতৃত্ব নিহত—এসব কারণে দুর্বল ছিল। আজ চিত্র উল্টো। ২০২১ সালের আগস্টে কাবুলে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর টিটিপি তাদের বিচ্ছিন্ন উপগোষ্ঠীগুলোকে একীভূত করেছে—আল-কায়েদামুখী ও সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠীও যুক্ত হয়েছে।
পেশোয়ারভিত্তিক এক জ্যেষ্ঠ আইনশৃঙ্খলা কর্মকর্তা বলেন, “তারা এখন পাকিস্তানজুড়ে ছড়িয়ে আছে, একইসঙ্গে আফগানিস্তানে নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেছে। তালেবান শাসন শুধু আশ্রয়ই দিচ্ছে না, আধুনিক অস্ত্র ও নাইট ভিশন যন্ত্রও জোগাচ্ছে—যেগুলো মার্কিন বাহিনী ফেলে গেছে।” এ মাত্রার সহায়তা আগের আফগান সরকার আশরাফ গনির সময়কার অবস্থানের চেয়ে স্পষ্টত ভিন্ন—যখন মাওলভি ফকির মুহাম্মদের মতো টিটিপি শীর্ষদের ধরতে ইসলামাবাদের সঙ্গে সহযোগিতা হয়েছে।
আফগান কারাগার থেকে শত শত টিটিপি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ায় সংগঠনটি পুনরায় সংগঠিত, অস্ত্রসজ্জিত ও অধিক পরিশীলিত অপারেশন চালাতে সক্ষম হয়েছে—এমনটাই কর্মকর্তাদের পর্যবেক্ষণ।
আরেক নতুন জিহাদি জোট ‘ইত্তেহাদুল মুজাহিদিন পাকিস্তান (আইএমপি)’—হাফিজ গুল বাহাদুর গোষ্ঠী, লস্কর-ই-ইসলাম ও ইনকিলাব-ই-ইসলামি পাকিস্তানকে নিয়ে—উদয় ঘটেছে। গঠনের পর থেকে তারা দক্ষিণ খাইবার পাখতুনখোয়ায় পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর ওপর একাধিক হামলা চালিয়েছে। পাঞ্জাবসহ অন্য প্রদেশেও বিস্তারের ইঙ্গিত দিয়েছে জোটটি।
পুরো সংঘাতে জঙ্গি ও রাষ্ট্র—উভয় পক্ষেরই ড্রোন ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে; দুর্ভাগ্যবশত এতে শিশুসহ বেসামরিক হতাহতও বেড়েছে।
অর্থনৈতিক সংকোচন, যুক্তরাষ্ট্রের কমে যাওয়া সহায়তা
এক দশক আগে যেভাবে শক্তিশালী বহিরাগত সহায়তা পেয়েছিল পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী প্রচেষ্টা—আজ তা নেই। ২০১৪ সালে রাজনৈতিক স্থিতি, তুলনামূলক ভালো অর্থনীতি, এবং যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল, গোয়েন্দা সহায়তা ও লক্ষ্যভিত্তিক ড্রোন হামলা—সব মিলিয়ে টিটিপিকে গুরুতরভাবে দুর্বল করা গিয়েছিল।
আজ অর্থনীতি অনেক খারাপ। ঋণের চাপ ও রাজস্ব সংকটে গোয়েন্দা তথ্যসংগ্রহ, আধুনিক প্রযুক্তি ক্রয়, বিশেষায়িত জনবল—সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের এসব অপরিহার্য খাতে বরাদ্দ কমে গেছে।
আবদুল বাসিতের ভাষায়, “যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ত্যাগ—যা একদিকে গোয়েন্দা ও আর্থিক সহায়তা দিত, অন্যদিকে টিটিপি-সহ গোষ্ঠীগুলোর আফগানিস্তানে যাতায়াত ঠেকাত—এই আঞ্চলিক গতিবিধি পুরো বদলে দিয়েছে।”
তবে কিছু সীমিত পুনঃসহযোগিতার লক্ষণ আছে। ২০২১ সালের কাবুল বিমানবন্দরের হামলায় নিহত মার্কিন সেনাদের ঘটনায় জড়িত এক আঞ্চলিক আইএসকেপি নেতাকে ধরতে পাকিস্তানের ভূমিকা ওয়াশিংটন স্বীকৃতি দিয়েছে। সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের দেড় মাসে দু’দফা ওয়াশিংটন সফর—যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পুনরায় সম্পৃক্ত হওয়ার ইসলামাবাদের প্রচেষ্টার সংকেত।
১১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বিএলএ এবং তাদের আত্মঘাতী ইউনিট ‘মাজিদ ব্রিগেড’-কে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
তবে বাসিত সতর্ক করেন—‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বা ২০২১-পূর্ব যুগের মতো সমন্বয় আর ফিরবে না। “তখন ছিল যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন, পাকিস্তান-সহায়তায় সন্ত্রাসবিরোধী টেমপ্লেট। এখন পাকিস্তান-নেতৃত্বাধীন, যুক্তরাষ্ট্র-সক্ষম করা সমীকরণ—ওয়াশিংটন প্রযুক্তিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা সহযোগিতা ও কিছু বিশেষ সরঞ্জাম দেবে; কিন্তু আর্থিক সহায়তা দেবে না,” তিনি বলেন। তাঁর মতে, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আর শীর্ষ অগ্রাধিকার নয়—এটি কৌশলগত নয়, ট্যাকটিক্যাল উদ্বেগ; ‘মুনির-ট্রাম্পের ব্রোম্যান্স’ও সীমিত, ট্যাকটিক্যাল ও লেনদেনভিত্তিক সহায়তাই খুলে দেবে।

ভ্রাতৃত্ব ও বুমেরাংয়ের মাঝে
তালেবান প্রশাসনের মধ্যমপদস্থ কর্মকর্তা কারি জামালউদ্দিন বলেন, “আফগানিস্তান থেকে মুহাজিরীনদের বহিষ্কারের দাবি পাকিস্তানের জন্য বলা সহজ; কিন্তু তা জিহাদি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে খাপ খায় না, ইসলামি বা পশতুুন ভ্রাতৃত্বের নীতির সঙ্গেও নয়।” এখানে ‘মুহাজিরীন’ বলতে ২০১৪ সালের ‘অপারেশন জার্ব-ই-আজব’-এর পর আফগানিস্তানে আশ্রয় নেওয়া পাকিস্তানি জঙ্গিদেরই বোঝানো হয়েছে।
২০২৩ সালের শেষ দিকে এক শীতের রাতে কাবুলে আমাদের সাক্ষাৎ। করাচিতে তাঁর সময় থেকেই আমি জামালউদ্দিনকে চিনি। তালেবানদের প্রথম শাসনের একনিষ্ঠ সমর্থক তিনি। ২০০১ সালের মার্কিন আক্রমণের পর পরিবার নিয়ে পাকিস্তানে পালান। নির্বাসনে এক মাদ্রাসায় পড়েন, কাপড়ের দোকান চালান, কিন্তু তালেবানের প্রত্যাবর্তনে তাঁর বিশ্বাস কখনো নড়েনি—“এটা সময়ের ব্যাপার,” বলতেন তিনি।
২০২১ সালের আগস্টে কাবুল পতনের পরই ইসলামাবাদ টিটিপির পাকিস্তানের ভেতরে হামলা ঠেকাতে তালেবান নেতৃত্বের কাছে অনুরোধ জানায়। উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। উল্টো তালেবান ইসলামাবাদকে টিটিপির ‘অভিযোগ’ শোনার ও শান্তি আলোচনায় বসার পরামর্শ দেয়—যা প্রাক্তন যুদ্ধসঙ্গীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপে তাদের অনীহার গভীরতা প্রকাশ করে। আলোচনা শুরু হলেও দ্রুত ভেঙে যায়; সহিংসতা ফের জেঁকে বসে।
আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান প্রশাসন বিদেশি জঙ্গিদের আশ্রয় দেয় না বলে দাবি করে, পাকিস্তানের উদ্বেগকে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু তাদের সন্ত্রাসবিরোধী নীতি বাছাই করা—আইএসকেপির বিরুদ্ধে কঠোর হলেও টিটিপির ব্যাপারে সহনশীল। তালেবান টিটিপিকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে না—বরং মতাদর্শগত নৈকট্য ও যুদ্ধসঙ্গীর সম্পর্কেই দেখে।
জামালউদ্দিনের মতে, ইসলামাবাদের তালেবান-সমর্থন ছিল সম্পূর্ণ লেনদেনমূলক—“ভারতীয় প্রভাব ঠেকাতে পাকিস্তান আমাদের সমর্থন দিয়েছে; কিন্তু একই সময়ে আমাদের নেতাদের আমেরিকানদের হাতে তুলে দিয়েছে। আমরা সহ্য করেছি, কারণ প্রতিটি বিদ্রোহকেই প্রতিবেশী কোনো দেশে আশ্রয় দরকার।”
পাকিস্তানে বহু ক্ষেত্রেই তালেবান এমন এক ‘সহায়ক’ ইকোসিস্টেম পেয়েছিল—যেখানে ২০০৩-এর পর থেকে তারা পুনর্গঠিত হয়ে প্রাণঘাতী বিদ্রোহে উঠতে পেরেছে। সে সমর্থন না থাকলে ক্ষমতায় ওঠা অনেক কঠিন হতো—স্বীকার করেন তিনি।
“রাষ্ট্র নয়, টিটিপি, পাকিস্তানি ধর্মীয় কর্মী আর মাদ্রাসাশিক্ষকেরাই তালেবানের পাশে অটলভাবে দাঁড়িয়েছিল,” বলেন তিনি। “ওরা আমাদের জন্য লড়েছে, প্রাণ দিয়েছে—উত্তর ওয়াজিরিস্তানে মার্কিন ড্রোনে তাড়া খেতে খেতে।”
তালেবান নেতৃবৃন্দ ও গবেষকদের অনেকেই মনে করেন, টিটিপির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপে তালেবানের অনীহার শিকড় রাজনীতির চেয়েও গভীরে। ব্রিটেনভিত্তিক আফগান গবেষক জাব্বার দুররানি বলেন, “তালেবান ও টিটিপির সম্পর্ক এক যৌথ মতাদর্শ, ইতিহাস ও সংস্কৃতির ওপর দাঁড়ানো। শুধু শীর্ষ নেতৃত্ব নয়, তৃণমূলেও ব্যক্তিগত ও অপারেশনাল সম্পর্ক রয়েছে।”
সাবেক আফগান শরণার্থীমন্ত্রী খলিলুর রহমান হাক্কানি—যিনি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আইএসকেপি হামলায় নিহত—২০২৩ সালে এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, টিটিপি প্রতিষ্ঠাতা বায়তুল্লাহ মেহসুদ একবার বহু পাকিস্তানি নিরাপত্তাকর্মী ধরে তালেবান বন্দিদের মুক্ত করান—যাঁদের মধ্যে তিনি নিজেও ছিলেন। এমন পর্ব অনেক তালেবান নেতার কাছে ‘যৌথ আত্মত্যাগের’ দীর্ঘস্থায়ী স্মারক।
এই ইতিহাস তালেবান র্যাঙ্কের কাছে টিটিপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাকে অকৃতজ্ঞতা—এবং ঝুঁকিপূর্ণ—দুইই করে তোলে। দুররানির সতর্কতা, “টিটিপির বিরুদ্ধে শক্ত হাতে গেলে সংগঠনের ভেতরে ভাঙন ধরার ঝুঁকি আছে, এবং তাদের যোদ্ধারা আইএসকেপির দিকে ঝুঁকতে পারে—যার সঙ্গে আফগান তালেবানের তীব্র দ্বন্দ্ব চলছে।”
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
জঙ্গি হামলার জোয়ারে ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তান কাবুলের তালেবান প্রশাসনকে টিটিপির বিরুদ্ধে পদক্ষেপে রাজি করাতে ‘হার্ড’ ও ‘সফট’ পাওয়ারের মিশ্র চাপ প্রয়োগ করছে।
২০২২ সাল থেকে পাকিস্তান পূর্ব আফগানিস্তানে অন্তত তিন দফা বিমান হামলা চালিয়েছে—সবচেয়ে গুরুতরটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, যখন পাকতিকা প্রদেশে সন্দেহভাজন পাকিস্তানি জঙ্গি আস্তানায় আঘাত হানা হয়।
পাশাপাশি ইসলামাবাদ অর্থনৈতিক ও জনতাত্ত্বিক চাপও প্রয়োগ করছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এক মিলিয়নের বেশি অবৈধ আফগান নাগরিককে বহিষ্কার, আগে খোলা চামান সীমান্তে কঠোর ভিসা নিয়ম, আফগান ট্রানজিট বাণিজ্যে কড়াকড়ি—এসবই চালু হয়েছে। জাতিসংঘ সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার সমালোচনা সত্ত্বেও এসব ব্যবস্থায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে, প্রয়োজনীয় আমদানিতে আফগানিস্তানের প্রবেশাধিকার সীমিত হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, অবৈধ বিদেশি নাগরিক নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের ‘সার্বভৌম অধিকার’। তবে সময়চয়নে কাবুলকে চাপ বাড়ানোর কৌশলগত ইঙ্গিত স্পষ্ট।

পাকিস্তানের আফগান নীতি কি ব্যর্থ?
এক জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেন, “১৯৭৯-এর সোভিয়েত আক্রমণ হোক, ২০০১-এর যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন হস্তক্ষেপ হোক—পাকিস্তান নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান কখনোই ‘উদাসীনতা’র বিলাসিতা দেয়নি। বিশ্বশক্তিকে জড়ানো সংঘাত-প্রবণ অঞ্চলের নৈকট্য সবসময় পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করেছে—জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়।”
পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের আফগান নীতি তীব্র বিতর্কিত—সমালোচকদের কাছে ভুলের পর ভুল। কিন্তু ইসলামাবাদের কর্মকর্তারা বলেন, দেশের অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় জটিল ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই নীতি ছিল ‘অবশ্যপালনীয়’। আজ তালেবানের টিটিপিবিরোধী পদক্ষেপে অস্বীকৃতি—রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তির ওপর দীর্ঘ নির্ভরতায় ইসলামাবাদের কৌশলের সীমা উন্মোচন করছে।
আশির দশকে সোভিয়েতবিরোধী আফগান মুজাহিদিনকে সশস্ত্র করা, ১৯৯৬ সালে তালেবানের উত্থানে সমর্থন, ২০০১-এ তাদের পতনের পরও যোগাযোগ—সব মিলিয়ে পাকিস্তান অনেক সময় আফগানিস্তানকে সার্বভৌম প্রতিবেশী নয়, ‘কৌশলগত গভীরতা’ হিসেবে দেখেছে। সমালোচকেরা বলেন, এর বুমেরাং—জঙ্গিবাদ পুষ্টি, সীমান্ত উত্তেজনা, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা।
আজ তালেবান শাসনের চার বছর পর পাকিস্তান সূক্ষ্ম ভারসাম্যে হাঁটছে। ১৯৯৬-এ তালেবান সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতি দিলেও ২০২১-এ তাদের ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে পাকিস্তান অনেক সতর্ক—আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নয়, ‘ডি ফ্যাক্টো’ স্বীকৃতিতে দূতাবাসীয় কাজ চলতে দেওয়া। ৯০-এর দশকের দ্রুত স্বীকৃতিতে আন্তর্জাতিক সমালোচনার অভিজ্ঞতা থেকেই এ মেপে চলা।
এখন ইসলামাবাদ আফগানিস্তানে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পক্ষে—চীন, রাশিয়া, ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গেও এই অবস্থান মেলে। বিভিন্ন জাতিগত ও রাজনৈতিক অংশীজনকে অন্তর্ভুক্ত করার ওপর জোর দেওয়া—একক কোনো শক্তির ওপর (যেমন তালেবান) অতিনির্ভরতা থেকে সরে এসে আন্তর্জাতিক ঐকমত্যের সঙ্গে নীতিসামঞ্জস্যের ইঙ্গিত।
এই নতুন পন্থা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক বৈধতার টানাপোড়েন সামলে এগোতে পারে কি না—পাকিস্তানের আফগান নীতির ভবিষ্যৎ তাতে নির্ভর করছে।

দৃঢ়তার স্বাদ
টিটিপি ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মতো সংগঠনের পুনরুত্থান বহু বছরের মধ্যে পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুতর নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। এটি আর কেবল প্রান্তিক এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়—ধীরে ধীরে ভেতরের জেলাতেও ঢুকছে।
পাঞ্জাবের ভাক্কার জেলায় সরকারি কর্মীদের খাইবার পাখতুনখোয়ার সংলগ্ন এলাকায় না যেতে সতর্ক করা হয়েছে—‘বিশ্বাসযোগ্য অপহরণ হুমকি’র কারণে। বেলুচিস্তানে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা স্থগিত—বিচ্ছিন্নতাবাদী হুমকির তীব্রতা ও বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাবের ইঙ্গিত।
আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের চার বছর আঞ্চলিক স্থিতি আনেনি—বরং পাকিস্তানের জন্য নিরাপত্তা, রাজনীতি ও অর্থনীতির জটিল জাল তৈরি করেছে। এক অস্বস্তিকর তুলনা সামনে আসে: সীমিত সম্পদেও তালেবান দেশটির ভেতরে নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে, আইএসকেপিকে দুর্বল করেছে; অথচ ব্যাপক ও পরিশীলিত নিরাপত্তা যন্ত্র থাকলেও পাকিস্তান পুনরুত্থানশীল জঙ্গিবাদ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে।
এই ব্যবধান পাকিস্তানের নিরাপত্তা মতবাদ নিয়ে সৎ ও সমালোচনামূলক পুনর্মূল্যায়নকে বাধ্য করছে। দীর্ঘদিনের হাতিয়ার ও কৌশল কি এই বদলে যাওয়া, আরও বিচিত্র ও জটিল হুমকির বিরুদ্ধে কার্যকর?
খাইবার পাখতুনখোয়ায় সহিংসতা বাড়তে থাকলে ইসলামাবাদকে সীমিত, গোয়েন্দানির্ভর দমনপদ্ধতি ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদি, ব্যাপক সামরিক অভিযানে ফিরতে হতে পারে। অনেকে মনে করেন, স্থানীয় জিরগা ও টিটিপির মধ্যে চলমান শান্তি কথোপকথনেরও দ্বৈত উদ্দেশ্য আছে—সমস্ত শান্তিপূর্ণ পথ শেষ হয়েছে তা দেখানো, এবং শক্ত পদক্ষেপের জন্য জনসমর্থন গড়া।
তবে সাফল্য শুধু শক্তি প্রদর্শনে মাপা যাবে না। জনআস্থা পুনর্গঠন, দৃশ্যমান সাফল্য দেখানো, এবং অতীতের চক্র এড়ানো—এসবই হবে মূল। সামনের মাসগুলোতে পাকিস্তান যে পথ বেছে নেবে—তা শুধু এ ঢেউ থামাবে কি না, তাই নয়; দেশের নিরাপত্তা অভিযাত্রাও দীর্ঘ সময়ের জন্য নির্ধারণ করবে।
লেখক পরিচিতি: সাংবাদিক ও গবেষক; তাঁর লেখা ডন, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং তিনি নানা নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন।
জিয়া উর রহমান 


















