দারুচিনি আমাদের রান্নার পরিচিত একটি মসলা। তবে এর ঔষধি গুণও অনেক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দারুচিনির পানি পান করার উপকারিতা নিয়ে নানা গবেষণা করেছেন। সকালে খালি পেটে এক গ্লাস দারুচিনির পানি পান করলে শরীরের জন্য নানা ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।
বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে দারুচিনিতে রয়েছে সিনামালডিহাইড, পলিফেনল এবং শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা শরীরের কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। তাই সকালের এক গ্লাস দারুচিনির পানি শুধু শরীরকে সতেজই রাখে না, বরং দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
দারুচিনি শরীরের রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং রক্তনালীর প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। যারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের জন্য এটি প্রাকৃতিক উপশম হিসেবে কাজ করতে পারে। নিয়মিত সকালে এক গ্লাস দারুচিনির পানি খেলে রক্তচাপের হঠাৎ ওঠানামা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
অতিরিক্তভাবে, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে দারুচিনি রক্তনালীকে শিথিল করতে সাহায্য করে, ফলে রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় আসে। এটি হার্টের উপর চাপ কমায় এবং দীর্ঘমেয়াদে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় রাখে
দারুচিনিতে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়। এটি স্নায়ু কোষে রক্ত ও অক্সিজেন প্রবাহ বাড়িয়ে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং মানসিক স্থিতি উন্নত করতে পারে। যারা মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা স্নায়ুর দুর্বলতায় ভুগছেন, তাদের জন্য এটি বিশেষ উপকারী হতে পারে।
এ ছাড়া দারুচিনি নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ যেমন আলঝেইমার এবং পারকিনসন রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হয়। সকালের পানি শরীরে প্রবাহিত হয়ে দ্রুত মস্তিষ্কে কাজ শুরু করে, যা স্নায়ুর ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়।
রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ
দারুচিনির অন্যতম প্রধান গুণ হলো রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ। এটি ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়, ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। সকালে খালি পেটে দারুচিনির পানি পান করলে গ্লুকোজের মাত্রা স্থিতিশীল থাকে, যা অতিরিক্ত ক্ষুধা কমাতে সহায়তা করে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দারুচিনির পানি শরীরে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়িয়ে দেয়। যারা টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাদের জন্য এটি প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা হতে পারে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট থেকে আসা গ্লুকোজ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনে।
হজমে সহায়ক
দারুচিনির পানি হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে। এতে থাকা জীবাণুনাশক ও প্রদাহনাশক উপাদান পাকস্থলীতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ করে এবং গ্যাস, অম্বল ও কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা কমায়। নিয়মিত খেলে হজমতন্ত্র সুস্থ থাকে এবং খাবার সহজে হজম হয়।
অতিরিক্তভাবে, এটি পাকস্থলীর অ্যাসিড ব্যালান্স বজায় রাখে, ফলে অম্বল কমে। দারুচিনির অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ খাবারে থাকা ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংস করে এবং অন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যকারিতা বজায় রাখে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
দারুচিনির অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিভাইরাল গুণ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করে। মৌসুমি সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা কিংবা সংক্রমণ প্রতিরোধে এটি কার্যকর হতে পারে। এ ছাড়া এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরের টক্সিন বের করে দেয়, যা সামগ্রিক সুস্থতায় ভূমিকা রাখে।
বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, দারুচিনি শরীরে ‘ইমিউন রেসপন্স’ দ্রুত সক্রিয় করে। ফলে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে শরীর সহজে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। শিশু থেকে প্রবীণ সবাই নিয়মিত দারুচিনির পানি খেলে মৌসুমি অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে
সকালে খালি পেটে দারুচিনির পানি পান করলে শরীরের বিপাকক্রিয়া বেড়ে যায়। এটি অতিরিক্ত চর্বি পোড়াতে সাহায্য করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে। অনেক পুষ্টিবিদ ওজন কমানোর ডায়েটে দারুচিনি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এ ছাড়া দারুচিনি ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে, ফলে অপ্রয়োজনীয় ক্যালরি গ্রহণ কমে যায়। যারা ডায়েট বা নিয়মিত ব্যায়াম করছেন, তাদের জন্য দারুচিনির পানি দ্রুত ওজন নিয়ন্ত্রণের সহজ উপায় হতে পারে।
সতর্কতা
যদিও দারুচিনির পানি উপকারী, তবে অতিরিক্ত সেবন করলে উল্টো ক্ষতি হতে পারে। প্রতিদিন এক গ্লাসের বেশি না খাওয়াই ভালো। যাদের লিভারের সমস্যা, গর্ভবতী নারী বা বিশেষ কোনো ওষুধ সেবন করছেন, তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিয়মিত দারুচিনির পানি খাওয়া উচিত নয়।
বিশেষ করে, দারুচিনিতে কুমারিন নামক এক উপাদান থাকে, যা অতিরিক্ত সেবনে লিভারের ক্ষতি করতে পারে। তাই একেবারেই নয়, বেশি সেবন না করে পরিমিত পরিমাণে খাওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত।
সহজ রেসিপি: কীভাবে বানাবেন দারুচিনির পানি
১. এক গ্লাস পানি ফুটিয়ে নিন।
২. তাতে একটি দারুচিনির কাঠি বা আধা চাচামচ গুঁড়া দারুচিনি দিয়ে ৫–৭ মিনিট সেদ্ধ করুন।
৩. হালকা ঠান্ডা হলে পানি ছেঁকে নিন।
৪. চাইলে সামান্য মধু মিশিয়ে খেতে পারেন।
এই পানীয় সকালে খালি পেটে পান করলে সর্বোচ্চ উপকার পাওয়া যায়।
প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস দারুচিনির পানি একটি সহজ কিন্তু কার্যকর স্বাস্থ্য অভ্যাস হতে পারে। এটি রক্তচাপ, স্নায়ুতন্ত্র, হজম, রক্তে শর্করা এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে পরিমিত পরিমাণে ও নিয়ম মেনে খাওয়াই হলো আসল চাবিকাঠি।