চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই–এর সদ্যসমাপ্ত ভারত সফর এবং ভারত–চীন সীমান্ত প্রশ্নে দুই দেশের মধ্যে হওয়া সমঝোতা—এই দুটোই ২০২০ সালের সীমান্ত অচলাবস্থার পর থেকে টালমাটাল সম্পর্ক মেরামতের একটি উৎসাহজনক ইঙ্গিত। দিল্লিতে ওয়াং ই–এর আলোচনা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য চীন সফরকে সামনে রেখে নিয়ন্ত্রিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য একগুচ্ছ পদক্ষেপের খসড়া চুক্তি বৃহত্তর ভূরাজনীতিতেও ঘটতে থাকা পরিবর্তনের প্রতিফলন। ভারত–চীন সমীকরণকে রাশিয়ার সঙ্গে উভয় দেশের সম্পর্কের যোগাযোগসূত্রে পড়তে হবে। রাশিয়া, ভারত ও চীন—এই ত্রিপাক্ষিক কথোপকথনগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কারণ এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাদের নীতির প্রতিক্রিয়ায় আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়।
বর্তমানে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। ভারত ও চীন (রাশিয়াও)—তিন পক্ষের এই আলাপ-আলোচনা ওয়াশিংটনের কাছে এমন এক বার্তা দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক প্রভাববলয়ের বাইরে বিকল্প বৈশ্বিক জোট ও পুনর্সামঞ্জস্যের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো—ভারত ও চীনের মধ্যে বর্তমান সদ্ভাবের নেপথ্য কারণগুলো। বাহ্যিক আড়ম্বর ছাড়াও স্পষ্ট যে, দুই দেশই নিজেদের সম্পর্কে একটি ন্যূনতম স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। ওয়াং ই–এর ভারত সফরের ফলাফল নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিও সেটিই প্রমাণ করে।

সুতরাং বলা যায়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নয়াদিল্লি ও বেইজিংয়ের মধ্যে একটি সমাপতন তৈরি হয়েছে। তবে ‘স্বাভাবিকতা’—দুটি দেশের কাছে দুটি ভিন্ন ধারণা। চীনের জন্য স্বাভাবিকতা মানে ভারতের সঙ্গে চলমান সীমান্ত জটিলতাকে আপাতত পিছনে ফেলে বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে মনোযোগী হওয়া। ওয়াং ই–এর ভাষায়, আমরা (ভারত ও চীন) কোনোভাবেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সীমান্ত প্রশ্ন দিয়ে সংজ্ঞায়িত হতে দিতে পারি না, কিংবা নির্দিষ্ট মতভেদের কারণে সামগ্রিক সম্পর্কের ছবিকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দিতে পারি না। ভারত–চীন সম্পর্কে স্বাভাবিকতা না এলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে ভারতের অসন্তুষ্টিকে নিজেদের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চীন কাজে লাগাতে পারবে না—এ কথা বেইজিং জানে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করার এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চীনের কাছে ভারতের সঙ্গে স্বাভাবিকতা সহায়ক। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সীমান্ত সমস্যা সমাধানে নয়াদিল্লির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ‘দেওয়া–নেওয়া’র আলোচনায় বসতে বেইজিং কি প্রস্তুত? ভারতের দৃষ্টিতে, চীনের সঙ্গে স্বাভাবিকতার কেন্দ্রবিন্দু হলো সীমান্তে বিচ্ছিন্নতা ও উত্তেজনা কমানো, যাতে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রশ্ন—ভারত–চীন সম্পর্ক, ভারত–চীন–রাশিয়া ত্রিভুজ—ইত্যাদিতে মনোযোগ দেওয়া যায়। ভারতের কাছে সীমান্তে স্বাভাবিকতা ও ২০২০ সালের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া—এই দুটিই মূল।
ভারতের প্রতি চীনের বর্তমান উষ্ণতার বৈশ্বিক উদ্দেশ্য চোখ এড়ানো উচিত নয়। ওয়াং সম্প্রতি বলেছেন, গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে আধিপত্যবাদ ও শক্তির রাজনীতির বিরোধিতায় নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই। এতে সন্দেহ নেই, চীন ভারত, রাশিয়া ও গ্লোবাল সাউথকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে চাইবে। কিন্তু এটাও স্পষ্ট—যদি ট্রাম্প চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ‘জি–২’ সমীকরণের প্রস্তাব দেন, তবে বেইজিং সম্ভবত তা মেনে নেবে এবং গৌণ ভূরাজনৈতিক সমীকরণগুলো বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠা বোধ করবে না।
এ একই যুক্তি রাশিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মস্কো যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বলয়ের বাইরে বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার গুণাবলি উচ্চকণ্ঠে প্রচার করবে বটে, কিন্তু তাদের প্রকৃত চাওয়া হলো—ওয়াশিংটন ও ইউরোপের কাছে মহাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা পাওয়া, এবং ইউরোপের ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যবস্থায় জায়গা করে নেওয়া—চীন-নেতৃত্বাধীন বৈশ্বিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়া নয়। ভারতের ক্ষেত্রে, নিউ দিল্লি গ্লোবাল সাউথ, বহুমেরুতা ও বৈশ্বিক বিকল্পের গুরুত্বে জোর দিলেও চীন-নেতৃত্বাধীন, রাশিয়া-সমর্থিত, ‘অ-আমেরিকান’ বিশ্বব্যবস্থার অংশ হতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। যদি যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থায় ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে সমাদৃত ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে নয়াদিল্লি সেটি গ্রহণ করতেই পারে।

আদর্শ পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি চাইবে চীনের শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং/অথবা রাশিয়া দ্বারা ভারসাম্যপূর্ণ হোক। কিন্তু যেহেতু এখনই সেই বিকল্প বাস্তবসম্মত নয়, ভারত আপাতত নিজে থেকে বেইজিংকে পুরোপুরি ভারসাম্য করতে অক্ষম হওয়ায় ‘আন্ডার-ব্যালান্সিং’—অর্থাৎ সীমিত পরিসরে ভারসাম্য তৈরির—পথে হাঁটছে। এই অর্থে ভারত, চীন ও রাশিয়া—তিন দেশই ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে হেজ করছে এবং নিজেদের ‘দ্বিতীয় সেরা’ বিকল্পে ঝুঁকছে। এই মৌলিক ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টির আড়াল হওয়া উচিত নয়। এদিকে, পারস্পরিক অবিশ্বাস গভীর থাকলেও চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পৃক্ততা দরকার অন্তত দুটি কারণে। প্রথমত, সম্পর্কের মৌলিক সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো অদূর ভবিষ্যতে দূর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তাই সংঘাত-পরিচালনা ভারত–চীন সম্পর্কে ভারতের জন্য অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি এজেন্ডা।
সে কারণেই সিনো–ইন্ডিয়ান উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আস্থা-গঠনের ব্যবস্থা (সিবিএম) প্রতিষ্ঠা ও জোরদার করা অত্যাবশ্যক। এ দিক থেকে সাম্প্রতিক সমঝোতাগুলো সঠিক পথে এগোনোর ইঙ্গিত দেয়।
দ্বিতীয়ত, চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক সম্পৃক্ততার আরেকটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন কারণ হলো—বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা—চীনের বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে উত্থান ও অতিমাত্রায় প্রভাবশালী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা, ভূখণ্ডগত দাবি আক্রমণাত্মকভাবে তাড়া করা, এবং এশিয়ায় একধরনের একমেরুবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা—এসব সামাল দেওয়াই আগামী কয়েক দশক ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে থাকবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নয়াদিল্লির বেইজিংয়ের সঙ্গে ফলপ্রসূ সম্পৃক্ততা বজায় রাখা প্রয়োজন।
হ্যাপিমন জ্যাকব ‘কাউন্সিল ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডিফেন্স রিসার্চ’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং ‘ইন্ডিয়াজ ওয়ার্ল্ড’ সাময়িকীর সম্পাদক।
হ্যাপিমন জ্যাকব 


















