জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলছে নজিরবিহীন অস্থিরতা। মাত্র কয়েক সপ্তাহে শত শত কর্মকর্তার বদলি, বরখাস্ত ও অবসরের সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে তৈরি হয়েছে তীব্র অনিশ্চয়তা। দেশের সবচেয়ে বড় রাজস্ব সংগ্রাহক সংস্থার এই পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—এতে কি সত্যিই সংস্কার সম্ভব হবে, নাকি আরও আস্থা সংকট বাড়বে?
বদলির ঝড় ও কর্মকর্তাদের ক্ষোভ
১২ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া বদলির আদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন। একই সময়ে বরখাস্ত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন, আর পাঁচজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক—আজ হঠাৎ বদলি, কাল হয়তো বরখাস্ত। এতে অনেকে মনে করছেন, শাস্তিমূলক ব্যবস্থার তুলনায় আস্থা তৈরির উদ্যোগই বেশি জরুরি ছিল।
আন্দোলনের মূল কারণ
অন্তর্বর্তী সরকার এনবিআর ভেঙে দুটি নতুন বিভাগ তৈরি করেছে—রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ। সরকারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নীতি ও বাস্তবায়ন আলাদা থাকলে স্বচ্ছতা বাড়বে।
কিন্তু কর্মকর্তাদের মতে, এতে প্রশাসন ক্যাডারের প্রভাব বেড়ে গেছে এবং কাস্টমস ও কর ক্যাডারের গুরুত্ব কমে গেছে। এর প্রতিবাদেই শুরু হয় সীমিত কর্মবিরতি, যা পরে পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনে রূপ নেয়।
চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা কাস্টমস হাউজ ও বেনাপোলে কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি: সংস্কার জরুরি, তবে আস্থা ফিরাতে হবে
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ শতাংশ—বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন। রাজস্ব আদায়ে সংস্কার জরুরি, কিন্তু বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রায়হান বলেন,
“আধুনিকায়ন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এনবিআরকে হঠাৎ দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। এতে দক্ষতা বাড়ার বদলে অসন্তোষ বেড়েছে।”
সাবেক এনবিআর একজন মেম্বর মনে করেন,
“কর্মকর্তাদের দাবিতে যুক্তি আছে। কিন্তু আন্দোলনের ধরন সঠিক হয়নি। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব আস্থা ফিরিয়ে আনা।”
ব্যবসায়ী মহলের উদ্বেগ
রাজস্ব আদায়ে অচলাবস্থা ব্যবসায়ী মহলকেও চিন্তিত করে তুলেছে। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্থবির হলে বন্দরগুলোতে জট তৈরি হয়, ব্যয় বেড়ে যায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যায়।
এক শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা বলেন,
“যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া এরকম অচলাবস্থা আমরা আগে দেখিনি। ব্যবসার ক্ষতি শুধু আজকের জন্য নয়, এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে থাকবে।”
সৎ বনাম অসৎ কর্মকর্তার বিতর্ক
আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় অনেক সৎ কর্মকর্তাও চাকরি হারাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে দুর্নীতি রোধ না হয়ে উল্টো উৎসাহিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সমালোচকরা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, শুধু শাস্তি নয়—সৎ কর্মকর্তাদের উৎসাহ দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
ব্যাংক তথ্য অ্যাক্সেস নিয়ে দ্বন্দ্ব
কর ফাঁকি রোধে এনবিআর এখন করদাতাদের ব্যাংক হিসাবের তথ্য রিয়েল-টাইমে চাইছে। এতে বার্ষিক সুদ আয়, উৎসে কর কর্তন এবং বছরের শেষ দিনের হিসাব অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ব্যাংকাররা আশঙ্কা করছেন, গোপনীয়তা ফাঁস হলে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন,
“সংবেদনশীল তথ্য বহু হাতে গেলে ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।”
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, যথাযথভাবে প্রয়োগ করা গেলে এই পদক্ষেপ কর ফাঁকি রোধে কার্যকর হবে এবং ব্যাংক খাতেও শৃঙ্খলা আনতে পারে।
সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ বাজেট ঘাটতি ও ঋণের চাপের মুখে রয়েছে। আবার কয়েক বছরের মধ্যেই দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে। এ অবস্থায় রাজস্ব আহরণ বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
তবে এজন্য শুধু কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ নয়, করদাতাদের আস্থাও জরুরি। সৎ করদাতাদের সুরক্ষা, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং কর্মকর্তাদের জন্য প্রণোদনার পরিবেশ—এসব মিলিয়েই ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কার সম্ভব।
এনবিআরের সাম্প্রতিক সংস্কার উদ্যোগের উদ্দেশ্য ভালো হলেও পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। আস্থা সংকট দূর না হলে বদলি-বরখাস্তের ঝড় আরও অনিশ্চয়তা তৈরি করবে—যার খেসারত শেষ পর্যন্ত দিতে হবে দেশের অর্থনীতিকে।
এনবিআরে বদলি-বরখাস্তের ঝড়: সংস্কার নাকি অনিশ্চয়তার সংকেত?
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ০১:৩৫:৩৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫
- 63
জনপ্রিয় সংবাদ




















