গর্ভাবস্থায় হতাশা ও উদ্বেগ অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেক নারীই দ্বিধায় পড়েন—নিজেদের ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য কী করবেন? অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট চালিয়ে যাবেন, নতুন করে শুরু করবেন, নাকি কোনো ওষুধ ছাড়াই চেষ্টা করবেন? যদিও গর্ভকালীন হতাশা ও উদ্বেগে প্রায় ২০ শতাংশ নারী ভোগেন, কিন্তু মাত্র প্রায় ৫ শতাংশ গর্ভবতী নারী এসএসআরআই (Selective Serotonin Reuptake Inhibitors) নামের বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট গ্রহণ করেন।
এফডিএ’র বিতর্কিত আলোচনা
সম্প্রতি মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (FDA)-এর একটি প্যানেল আলোচনা করে যে, এসএসআরআই ওষুধে ব্ল্যাক-বক্স সতর্কীকরণ থাকা উচিত কি না। এটি স্বাস্থ্য ও মানবসেবা সচিব রবার্ট এফ. কেনেডি জুনিয়রের সাইকোট্রপিক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহারের সমালোচনার ধারাবাহিকতা।
এই আলোচনার প্রেক্ষাপট হলো যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ মাতৃমৃত্যুর হার, যা উন্নত বিশ্বের মধ্যে অন্যতম। মানসিক স্বাস্থ্যের জটিলতাগুলো সন্তান জন্মের পর এক বছর পর্যন্ত মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
চিকিৎসক ও গবেষকদের ভিন্নমত
এফডিএ’র প্যানেলে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ বক্তা এসএসআরআই ব্যবহারের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে চিকিৎসক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলো এর বিরোধিতা করে বলে, ওষুধের ঝুঁকির পাশাপাশি চিকিৎসাহীন হতাশার ঝুঁকিও বিবেচনা করতে হবে।

হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক ক্রিস্টা হুইব্রেখটস বলেন, গর্ভবতী নারীদের ওপর র্যান্ডমাইজড স্টাডি করা যায় না নৈতিক কারণে, তাই পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণার ওপর নির্ভর করতে হয়। পুরনো কিছু গবেষণায় এসএসআরআই ব্যবহারের সঙ্গে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি দেখা গেলেও সাম্প্রতিক উন্নত গবেষণায় দেখা গেছে, ঝুঁকি খুবই কম। তার মতে, একটি বা দুটি গবেষণা আলাদা করে দেখার পরিবর্তে সামগ্রিক প্রমাণ মূল্যায়ন জরুরি।
বিরোধী অবস্থান
ম্যাসাচুসেটসের মেট্রোওয়েস্ট মেডিকেল সেন্টারের মাতৃ-ভ্রূণ চিকিৎসা প্রধান ডা. অ্যাডাম উরাটো একমত নন। তার মতে, “এটি মূলত রাসায়নিক এক্সপোজারের সমস্যা। মা যে ওষুধ খাচ্ছেন তা প্লাসেন্টা পেরিয়ে শিশুর দেহে যাচ্ছে।” তিনি পশু ও মানব গবেষণার উদাহরণ টেনে বলেন, এসএসআরআই ব্যবহার গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, অকাল প্রসব ও দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার সঙ্গে যুক্ত। তবে সমর্থকেরা বলেন, চিকিৎসাহীন হতাশাও একই ঝুঁকি বাড়ায়—গর্ভপাত, অকাল প্রসব ও জটিলতা।
রোগীদের অভিজ্ঞতা
৪২ বছর বয়সী বারবারা অ্যাকম্যান দীর্ঘদিন হতাশা ও উদ্বেগে ভুগে এসএসআরআই শুরু করেন। তৃতীয়বার গর্ভবতী হলে ডাক্তার ঝুঁকি-সুবিধা জানালেও তিনি ওষুধ চালিয়ে যান। সন্তান জন্মের পর নবজাতক সাময়িকভাবে ‘নিওনেটাল অ্যাডাপটেশন সিন্ড্রোম’-এ ভোগে—শিশুর কাঁপুনি, অস্থিরতা ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, যা কয়েক দিনের মধ্যেই সেরে যায়। তিনি বলেন, “আমার ঘরের অন্য বাচ্চাদের কথা ভেবে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।”
প্রায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ গর্ভবতী নারীর শিশুর মধ্যে এ সিন্ড্রোম দেখা যায়, যা সাধারণত ক্ষণস্থায়ী। তবে কিছু চিকিৎসক বলেন, এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

‘শূন্য ঝুঁকি’ নেই
টরন্টোর উইমেনস কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সিমোন ভিগড বলেন, গর্ভাবস্থায় হতাশা থাকলে কোনো বিকল্পই ঝুঁকিমুক্ত নয়। ওষুধ খাওয়া বা না খাওয়া—দুটির সঙ্গেই ঝুঁকি রয়েছে।
ইউম্যাস মেমোরিয়াল হেলথের প্রসূতিবিদ ডা. টিফানি মুর সিমাস জানান, বড় গবেষণায় দেখা যায় প্রায় অর্ধেক নারী গর্ভাবস্থায় অ্যান্টিডিপ্রেসান্ট বন্ধ করে দেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, এসএসআরআই ব্যবহারে নবজাতকের পালমোনারি হাইপারটেনশন ও মায়ের প্রসবপরবর্তী রক্তক্ষরণের ঝুঁকি সামান্য বাড়ে। তবে তার মতে, “মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এড়ানো যায় না। কিন্তু চিকিৎসার পথ বেছে নেওয়া যায়, আর অনেক সময় এসএসআরআই জীবনরক্ষাকারী হতে পারে।”
চিকিৎসকেরা বলেন, হালকা হতাশার ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং ও জীবনধারার পরিবর্তন যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু মাঝারি থেকে গুরুতর ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্ল্যাক-বক্স সতর্কীকরণ জুড়ে দিলে চিকিৎসার প্রতি সামাজিক কুসংস্কার আরও বাড়তে পারে।
তাদের মতে, শিশুর সুস্থতার অন্যতম উপায় হলো মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















