আফগানিস্তান আজও চরম অস্থিরতার মধ্যে ডুবে আছে। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর শান্তি ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে দেশে বেড়েছে বিধ্বংসী সহিংসতা—যা মব ভায়োলেন্স বা জনতার হিংসার রূপে প্রকাশ পাচ্ছে। মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষোভ, রাজনৈতিক প্ররোচনা আর তালেবানি নিয়ন্ত্রণহীনতার মিশ্রণে এই সহিংসতা ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।
দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়া
মব ভায়োলেন্স শুধু কাবুল বা উত্তরাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই, তা ধীরে ধীরে দক্ষিণ আফগানিস্তানের তালেবান শক্ত ঘাঁটিগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে। কান্দাহার, হেলমান্দ বা উরুজগানের মতো অঞ্চলে, যেখানে তালেবানের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব সবচেয়ে বেশি, সেখানে সাধারণ মানুষও ক্রমশ জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার প্রবণতায় অভ্যস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, উপজাতি বিরোধ, এমনকি চুরির মতো ক্ষুদ্র অপরাধের ক্ষেত্রেও জনতা তথাকথিত ন্যায়বিচার এর নামে করতে নামছে। এর ফলে একদিকে তালেবানের কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে সমাজ আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে।
নারীর ওপর মব আক্রমণ
তালেবান শাসনে নারী সবচেয়ে বেশি অসুরক্ষিত। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাধীনতা হারানো নারীরা সামাজিকভাবে চরম দুর্বল অবস্থানে। এই প্রেক্ষাপটে নারীদের বিরুদ্ধে জনতার হিংসা বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নারীরা পোশাক, চলাফেরা কিংবা সামান্য সামাজিক নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগে তালেবান-সমর্থিত জনতার হাতে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রকাশ্যে মারধর, পাথর ছোড়া, এমনকি মৃত্যুর মতো নৃশংস আক্রমণের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নারী। তালেবান বাহিনী এ ধরনের হামলা রোধের বদলে প্রায়ই জনতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে অথবা নিজেরাই হামলার অংশ হয়ে উঠছে।
সামাজিক প্রভাব
এই ধরনের মব ভায়োলেন্স আফগান সমাজে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। মানুষ আইন বা বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারাচ্ছে। নারীরা ঘরে বন্দি হয়ে পড়ছে, জনসমক্ষে বের হওয়াও একধরনের ঝুঁকি। পাশাপাশি, ভিন্নমত দমন করতে তালেবান এই জনতা-নির্ভর হিংসাকে এক ধরনের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার প্রতিবেদন
জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আফগানিস্তানে মব ভায়োলেন্সের বিস্তার নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ২০২৪ সালের পর থেকে আফগানিস্তানে নারী ও সংখ্যালঘুদের ওপর জনতার হামলার ঘটনা দ্বিগুণ বেড়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, গ্রামীণ অঞ্চলে তালেবান প্রশাসন কার্যত জনতার হাতে বিচার প্রক্রিয়া ছেড়ে দিয়েছে, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র অভিযোগেও প্রাণঘাতী হামলা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একদিকে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখলেও, তালেবান সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনায় এ বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হচ্ছে। তবে তালেবান বরাবরের মতোই এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও প্রতিবেশী দেশগুলো উদ্বেগ জানালেও মাঠ পর্যায়ে কোনো বাস্তব পরিবর্তন এখনও দেখা যায়নি।
মানবাধিকার কর্মীরা আশঙ্কা করছেন, যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তবে মব ভায়োলেন্স আফগানিস্তানের সামাজিক সংকটকে আরও জটিল করবে এবং নারী ও শিশুদের জীবন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে।
আফগানিস্তানে মব ভায়োলেন্স আজ রাষ্ট্রীয় সংকটের এক প্রতীক। তালেবান ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও সমাজের ভেতরে জনতার হিংসা এমন এক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে যা নারী, সংখ্যালঘু ও সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে। দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত এর বিস্তার প্রমাণ করছে, এ সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং গোটা দেশের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ার এক প্রতিচ্ছবি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















