ইতালির মূল ভূখণ্ড ও সিসিলিকে যুক্ত করার বহুল আলোচিত মেসিনা ব্রিজ প্রকল্পকে দেশটির অডিট কোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ও অবকাঠাম্যমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, সরকারি ক্ষমতা ও ইতালির বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন–ক্ষমতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে।
প্রকল্প আটকে গেল আদালতে
অডিট কোর্ট অনুমোদন না দিয়ে জানায়, প্রকল্পটিতে একাধিক নথিগত ত্রুটি, প্রক্রিয়াগত ঘাটতি এবং ইউরোপীয় পরিবেশ ও ক্রয়বিধির সম্ভাব্য লঙ্ঘনের ঝুঁকি রয়েছে। বিচারকদের এই সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষুব্ধ হন প্রধানমন্ত্রী মেলোনি, যিনি অভিযোগ করেন—আদালত তাদের ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়েছে।
তবে বিষয়টি অপ্রত্যাশিত ছিল না। মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র জানায়, বিশেষজ্ঞরা সালভিনিকে কয়েক মাস আগেই সতর্ক করেছিলেন নথি অসম্পূর্ণ অবস্থায় অনুমোদন তাড়াহুড়ো করে না দিতে। কিন্তু সালভিনি ১৩.৫ বিলিয়ন ইউরোর এই প্রকল্প বছরের শেষেই শুরু করতে অনড় ছিলেন।
সালভিনির রাজনৈতিক ঝুঁকি

ইতালির ডানপন্থী রাজনীতিতে একসময় শীর্ষস্থানীয় ছিলেন সালভিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি মেলোনির কাছে প্রভাব হারিয়েছেন। সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে না পারলে তার নেতৃত্ব আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের কাছে ইতালির অবকাঠামো নির্মাণ–ক্ষমতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফ্রানচেস্কো গালিয়েত্তি বলেন, “এটা সরকারের জন্য বিব্রতকর। প্রশ্ন হলো—মেলোনি কি সালভিনির জন্য রাজনৈতিক ঝুঁকি নেবেন?”
দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, কখনও হয়নি শুরু
সিসিলি ও কালাব্রিয়ার মধ্যবর্তী মেসিনা প্রণালীতে সেতু নির্মাণের চিন্তা কয়েক দশক ধরে চলছে। ৩.৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পরিকল্পিত ঝুলন্ত সেতুটি হলে তা হবে বিশ্বের দীর্ঘতম। কিন্তু বিপুল ব্যয়, পরিবেশগত উদ্বেগ এবং জনমতের বিভাজনের কারণে কাজ কখনও শুরু হয়নি।
সরকার বলছে, সেতুটি জিডিপি ১% বাড়াতে পারে, আনতে পারে ২৩.১ বিলিয়ন ইউরোর অর্থনৈতিক প্রভাব এবং তৈরি করবে প্রায় ৩৬,৭০০ নতুন কর্মসংস্থান।
বর্তমানে সিসিলি-কালাব্রিয়ার সংযোগ শুধুই ফেরিতে, যা ২০ মিনিটের পথ হলেও বোর্ডিং–সহ প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে। সেতু হলে সময় নেমে আসবে ১০–১৫ মিনিটে।

সমালোচকরা বলছেন, এ প্রকল্প পরিবেশের ক্ষতি করবে এবং সিসিলি ও কালাব্রিয়ার জরুরি অভ্যন্তরীণ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন থেকে অর্থ সরিয়ে নেবে।
সম্ভাব্য নতুন টেন্ডারের ভয়
মেলোনির সরকার চাইলে আদালতকে ‘শর্তসাপেক্ষে’ অনুমোদন দিতে বাধ্য করতে পারে। কিন্তু এতে ভবিষ্যতে আরও মামলার ঝুঁকি বাড়বে।
দুইটি সূত্র জানায়—সরকার আদালতের উদ্বেগ সমাধান করে পূর্ণাঙ্গ অনুমোদন পাওয়ার পরিকল্পনা করছে।
সবচেয়ে বড় সংকট হলো—প্রকল্পের জন্য হয়তো নতুন টেন্ডার লাগতে পারে। সরকার অতীতে (২০০৫) ইউরোলিংক কনসোর্টিয়ামকে দেওয়া পুরোনো চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করে সময় বাঁচাতে চেয়েছিল। কিন্তু খরচ বৃদ্ধি, অর্থায়ন পরিবর্তন এবং নথির অনিশ্চয়তা নতুন টেন্ডারের প্রয়োজন তৈরি করতে পারে—যা নির্মাণ শুরুতে বহু বছর দেরি করাবে।
ইউরোলিংক (ইতালির ওয়েবিল্ড, স্পেনের সাসির এবং জাপানের আইএইচআই) ইতিমধ্যেই ৭০০ মিলিয়ন ইউরোর ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে, যা কেবল প্রকল্প পুনরায় শুরু হলেই প্রত্যাহার করা হবে।

সালভিনি সতর্ক করে বলেন, “নতুন টেন্ডার মানে সেতু প্রকল্প বাতিলের সমান।”
পরিবেশগত প্রশ্নে সরকারের দুর্বলতা
অডিট কোর্ট বলেছে, পরিবেশগত মূল্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ নথি অনুপস্থিত এবং সরকারের ব্যাখ্যাও অপর্যাপ্ত। সরকার ‘জরুরি জনস্বার্থের’ যুক্তি দেখিয়ে সেতু নির্মাণ এগিয়ে নিতে চাইলেও বিচারকদের মতে এই যুক্তির শক্ত ভিত্তি নেই।
পরিবেশবিদ আউরেলিও অ্যাঞ্জেলিনি বলেন, “এটি কোনো সামরিক স্থাপনা নয়। বরং সামরিক লক্ষ্য হওয়ার আশঙ্কা বেশি।” সরকারের দাবি ছিল—সেতুটি ন্যাটোর সৈন্য চলাচলেও সহায়ক হতে পারে, যা সমালোচকরা প্রতিরক্ষা খাতের বাজেট দেখানোর কৌশল হিসেবে দেখছেন।
সালভিনি এখনো আশা ছাড়েননি। তিনি বলেছেন, “কিছুটা সময় লাগতেই পারে, তবে আশা করি আমার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে নির্মাণ শুরু করতে পারব।” তবে আদালতের আপত্তি দূর না হলে ২০৩২ সালে নির্মাণ শেষ করার লক্ষ্য আরও দূরের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















