সামরিক শাসনের চার বছর পর মার্কিন নীতির পরিবর্তন
মিয়ানমারে ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর চার বছর অতিক্রান্ত। সম্প্রতি সামরিক সরকার জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে ২৮ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে এই নির্বাচনকে অনেকেই নাটকীয় পদক্ষেপ বলে মনে করছেন, যার লক্ষ্য আন্তর্জাতিক চাপ কমানো। আশ্চর্যের বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত নিন্দা জানালেও এবার নীরবতা বজায় রেখেছে। এতে ধারণা জোরালো হচ্ছে যে, ওয়াশিংটন হয়তো মিয়ানমারের প্রতি তাদের নীতি পাল্টাচ্ছে।
ট্রাম্পের চিঠি ও সামরিক নেতার কূটনৈতিক সাফল্য
৭ জুলাই ট্রাম্প সামরিক প্রধান মিন অং হ্লাইংকে উদ্দেশ করে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রপ্তানির ওপর শুল্ক ৪৪ শতাংশের পরিবর্তে ৪০ শতাংশ করার ঘোষণা দেন। চিঠিতে ট্রাম্প তাকে রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্য ব্যবহৃত “হিজ এক্সেলেন্সি” সম্বোধন ব্যবহার করেন, যা কার্যত সামরিক শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইঙ্গিত।
হ্লাইং দুই দিন পর উত্তরে ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানিয়ে ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে ট্রাম্পের “ভোট জালিয়াতির” অভিযোগের সঙ্গে নিজের অভ্যুত্থানকে মিলিয়ে নেন। একইসঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার আহ্বান জানান।

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও মার্কিন কূটনৈতিক নির্দেশনা
২৪ জুলাই মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ হঠাৎ করে মিয়ানমারের সেনাশাসনের ঘনিষ্ঠ তিনটি প্রতিষ্ঠান ও চার ব্যক্তির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। এছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কূটনীতিকদের নির্দেশ দেন বিদেশি নির্বাচনের সুষ্ঠুতা বা বৈধতা নিয়ে কোনো মন্তব্য না করতে। এটি ছিল মার্কিন অবস্থানে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর মিয়ানমারের সামরিক সরকার দ্রুতই একটি মার্কিন লবিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বছরে তিন মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পরিষ্কার বার্তা।
সামরিক নির্বাচনের পরিকল্পনা ও সহিংস বাস্তবতা
মিয়ানমারের সেনারা দাবি করছে ২০২০ সালের নির্বাচনে অং সান সু চির এনএলডি জালিয়াতির মাধ্যমে জিতেছিল। অথচ এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। অভ্যুত্থানের পর সেনাদের সহিংসতায় ইতিমধ্যেই সাত হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। এখনো চলমান গৃহযুদ্ধের মাঝেই সেনারা এমন নির্বাচন করছে, যেখানে গণতান্ত্রিক বিরোধীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। এর ফলে তাদের ঘনিষ্ঠ দল ইউএসডিপির জয় নিশ্চিত করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত মানদণ্ড ও আন্তর্জাতিক তুলনা
ওয়াশিংটনের এমন অবস্থান উদ্বেগ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে নেতা দাবি করলেও এখন যেন স্বৈরশাসন মেনে নিতে প্রস্তুত। ইউক্রেন যুদ্ধের মতো এখানেও শক্তির জোরে বাস্তবতা বদলের চেষ্টা উপেক্ষা করা হচ্ছে।
অতীত নীতির মোড় ঘোরানো মুহূর্তগুলো
- ১৯৬২ অভ্যুত্থান: সেনারা ক্ষমতা দখল করলেও মার্কিন আগ্রহ ছিল সীমিত, কারণ অর্থনৈতিক স্বার্থ কম ছিল।
- ১৯৮৮ ছাত্র আন্দোলন: গুজব ছড়ালেও যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি, কেবল কূটনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছিল।
- ১৯৯৭ সালে সুচির বার্তা: নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত বক্তৃতা মার্কিন নীতি বদলায়। বিল ক্লিনটন নিষেধাজ্ঞা দেন, পরে জর্জ ডব্লিউ বুশ আরও কঠোর ব্যবস্থা নেন।
- ওবামা যুগ: ২০০৯ থেকে “চাপ ও সংলাপ” উভয় পথ অনুসরণ করা হয়। ২০১১ সালে সংস্কার শুরু হলে ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়। হিলারি ক্লিনটন ও পরে ওবামার ঐতিহাসিক সফর হয়।
- সুচি-নির্ভর নীতি: ২০১৫ সালে এনএলডির বিজয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাও ছিল। তবে সেনারা একে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছিল।
আদর্শবাদী নীতি থেকে অর্থনৈতিক বাস্তবতায়
ঐতিহাসিক ক্রেইগ ক্লাফটার বলেন, মার্কিন নীতি ছিল সুচিকে দিয়ে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, যা বাস্তবতার বদলে আদর্শবাদে ভর করে ব্যর্থ হয়।
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট বাইডেন দ্রুত নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু চীন-রাশিয়ার প্রতিযোগিতা, আফগানিস্তান, ইউক্রেন ও গাজা সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার বদলে যায়। মিয়ানমার তখন পিছনের সারিতে চলে যায়।
এখন ফের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, তবে তা গণতন্ত্র নয়, অর্থনৈতিক সম্পদের কারণে। মিয়ানমার বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ রেয়ার আর্থ উৎপাদক। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পুনর্মূল্যায়নের লক্ষ্য এই খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।

সামরিক আকাঙ্ক্ষা ও আন্তর্জাতিক শঙ্কা
খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ থান্ট মিন্ট-ইউ তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ১৯৮০-এর দশকেই সেনারা বলেছিল তারা “বামপন্থী বিচ্ছিন্ন শাসন” থেকে “ডানপন্থী মার্কিনপন্থী একনায়কতন্ত্রে” যেতে চায়। চার দশক পরও এই আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট।
যদি ট্রাম্প প্রশাসন সত্যিই সামরিক সরকারের সঙ্গে সরাসরি অর্থনৈতিক সহযোগিতা শুরু করে, তবে এটি হবে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার আরেকটি ভয়াবহ উদাহরণ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















