লবণের প্রতি মানুষের আসক্তি
২০১৭ সালে তুর্কি শেফ নুসরেত গকচে, যিনি “সাল্ট বে” নামে খ্যাত, লবণ ছিটানোর অভিনব ভঙ্গিতে ভাইরাল হন। আসলে লবণ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সতর্কতা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে প্রায় সবাই প্রয়োজনের দ্বিগুণ লবণ খায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, খুব কম লবণ খাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
লবণ কেন প্রয়োজনীয়
লবণের মূল উপাদান সোডিয়াম আমাদের শরীরে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখা, অক্সিজেন ও পুষ্টি পরিবহন এবং স্নায়ুর সংকেত চালাতে অপরিহার্য। কিন্তু ইতিহাসে মানুষের লবণ খাওয়ার মাত্রা সবসময়ই প্রস্তাবিত সীমার ওপরে ছিল।

কতটা লবণ খাওয়া উচিত
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO): দিনে ২ গ্রাম সোডিয়াম (প্রায় ৫ গ্রাম লবণ)
- যুক্তরাষ্ট্র: সর্বোচ্চ ২.৩ গ্রাম সোডিয়াম (প্রায় এক চা চামচ লবণ)
- যুক্তরাজ্য: দিনে সর্বোচ্চ ৬ গ্রাম লবণ
বাস্তবে যুক্তরাজ্যে গড় খাওয়া ৮.৪ গ্রাম, যুক্তরাষ্ট্রে ৮.৫ গ্রাম এবং বিশ্বব্যাপী গড় ১০.৮ গ্রাম। গবেষণা বলছে, ৩–৬ গ্রাম সোডিয়াম খাওয়া হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সবচেয়ে কার্যকর।
আমরা নিজেরা রান্নায় যত লবণ দিই, তার চেয়ে বেশি লুকিয়ে থাকে রুটি, সস, স্যুপ, সিরিয়াল, পিজ্জা, মাংসজাত খাবার ও স্ন্যাকসে।
অতিরিক্ত লবণের ক্ষতি
- রক্তচাপ বাড়ায়, যা স্ট্রোক ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
- WHO অনুসারে, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ লবণ খাওয়ার ফলে প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১.৮৯ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটে।
- একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৫ গ্রাম বেশি লবণ খাওয়া হৃদরোগের ঝুঁকি ১৭% এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৩% বাড়ায়।

লবণ কম খাওয়ার সুফল
- ইংল্যান্ডে এক জরিপে দেখা যায়, দিনে ১.৪ গ্রাম লবণ কম খাওয়ায় রক্তচাপ কমেছে এবং মৃত্যুহারও ৪০% কমেছে।
- ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র এক সপ্তাহ কম সোডিয়াম খাদ্য খেলে রক্তচাপ কমানোর প্রভাব রক্তচাপের ওষুধের সমান।
- জাপান ও ফিনল্যান্ডে সরকারের প্রচারে লবণ খাওয়া কমায় স্ট্রোক ও হৃদরোগের মৃত্যুহার ৭৫-৮০% হ্রাস পেয়েছে।
ব্যক্তিভেদে ভিন্ন প্রভাব
সবার ক্ষেত্রে লবণের প্রভাব একই নয়। বয়স, জাতিগত বৈশিষ্ট্য, ওজন, স্বাস্থ্য এবং পারিবারিক ইতিহাসের উপর নির্ভর করে কারও লবণ সংবেদনশীলতা বেশি, কারও কম।
কম লবণ খাওয়ার সম্ভাব্য ঝুঁকি
কিছু গবেষণা বলছে, খুব কম লবণ খাওয়াও ক্ষতিকর হতে পারে।
- এক মেটা-অ্যানালাইসিসে দেখা গেছে, দিনে ৫.৬ গ্রামের কম বা ১২.৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, হৃদযন্ত্রের অসুস্থ রোগীদের ক্ষেত্রে কঠোর লবণ-নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়েছে।
- আরেকটি বৃহৎ গবেষণায় দেখা গেছে, ৭.৫ গ্রামের নিচে খাওয়া মানুষের হৃদরোগ ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি, যেখানে ৭.৫–১২.৫ গ্রামের মধ্যে খাওয়া অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
গবেষক অ্যান্ড্রু মেনটে বলেন, লবণের একটি “মধ্যপথ” আছে — অতিরিক্ত ও অতি-স্বল্প উভয়ই ক্ষতিকর, মাঝারি মাত্রা সবচেয়ে ভালো।

বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ একমত নন। অধ্যাপক ফ্রান্সেসকো কাপুচ্চিওর মতে, যে কোনো মাত্রায় লবণ কমানোই রক্তচাপ কমায়। অন্যদিকে, ব্রিটিশ নিউট্রিশন ফাউন্ডেশনের সায়েন্স ডিরেক্টর সারা স্ট্যানার মনে করেন, বাস্তবে দিনে ৩ গ্রামের নিচে নামা প্রায় অসম্ভব, কারণ কেনা খাবারেই লবণ মিশে থাকে।
খাদ্যশিল্পের ভূমিকা ও বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাজারজাত খাবারের লবণ কমানো সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। কিছু গবেষক আবার বলেন, ফল, সবজি, বাদাম ও দুগ্ধজাত খাবারে থাকা পটাশিয়াম লবণের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা কমাতে পারে।
গবেষণার ভিন্ন ভিন্ন ফলাফলের পরও সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো — অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বাড়ায় এবং মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়। তাই লবণ খাওয়া একেবারে বাদ না দিয়ে সচেতনভাবে কমাতে হবে এবং খাবারে লুকিয়ে থাকা লবণের দিকেও নজর রাখতে হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















