প্রচলিত ধারণা বনাম নতুন আবিষ্কার
সাধারণ ধারণা হলো, ক্যানসার শুরু হয় যখন কোনো স্বাভাবিক কোষের ডিএনএতে মিউটেশন ঘটে। এই পরিবর্তিত কোষ তখন শরীরের নিয়ন্ত্রণ ভেঙে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে এবং টিউমার তৈরি করে। পরবর্তীতে তা শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, তথাকথিত ‘ক্যানসার-ড্রাইভার মিউটেশন’ সুস্থ টিস্যুতেও প্রচুর পাওয়া যায়। মধ্যবয়সে পৌঁছালে খাদ্যনালীর অর্ধেকের বেশি অংশ ও পাকস্থলীর প্রায় ১০ শতাংশ কোষে এ ধরনের মিউটেশন থাকে। এমন কোষ ফুসফুস, ডিম্বাশয়, কোলনসহ বহু অঙ্গে পাওয়া গেছে।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো—এসব কোষ সবসময় টিউমারে পরিণত হয় না। গবেষকেরা এখন বুঝতে শুরু করেছেন যে সুস্থ কোষগুলো, যাদের ডিএনএতে উপকারী মিউটেশন আছে, তারা এই ক্ষতিকর কোষগুলোর বিস্তার ঠেকাতে পারে। ফলে সুস্থ কোষের বৃদ্ধি বাড়ানো ভবিষ্যতে ক্যানসার প্রতিরোধের কার্যকর কৌশল হতে পারে।

কোষের প্রতিযোগিতা ও ভারসাম্য
প্রতিটি কোষ বিভাজনের সময় নতুন কিছু র্যান্ডম মিউটেশন নিয়ে জন্মায়। খাদ্যনালী, ত্বক বা পাকস্থলীর বাইরের স্তরে যেসব কোষ পরিবেশের সঙ্গে বেশি খাপ খায়, তারা অন্যদের সরিয়ে দেয়।
প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু বিশেষ মিউটেশনযুক্ত কোষ প্রতিবেশী ঝুঁকিপূর্ণ কোষগুলোকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। এমনকি ১০০ কোষেরও কম ছোট টিউমারকেও সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তে এই মিউটেশনযুক্ত কোষের সংখ্যা ওঠানামা করে। এর মানে, উপকারী কোষকে বাড়তে দেওয়া ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে।
বিপজ্জনক মিউটেশন আর ওষুধের সম্ভাবনা
একটি সাধারণ ক্যানসার-ড্রাইভার মিউটেশন দেখা যায় PIK3CA জিনে, যা কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রিটেনের ওয়েলকাম স্যাঙ্গার ইনস্টিটিউটের গবেষক ফিল জোন্স দেখিয়েছেন, এ মিউটেশন কোষকে এমনভাবে বদলায় যে তারা সুস্থ কোষকে হারিয়ে ফেলে।
তবে ২০২৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিসের সাধারণ ওষুধ মেটফর্মিন সুস্থ কোষে একই ধরনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ফলে তা অসুস্থ কোষের বিস্তার রোধ করে। বিপরীতে, উচ্চ-চর্বিযুক্ত খাদ্য ক্ষতিকর কোষকে বাড়তে সাহায্য করে। স্থূল মানুষের মধ্যে এ ধরনের কোষ বেশি পাওয়া যায়। তাই খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।

গবেষণার সীমাবদ্ধতা
মানবদেহে হাজারো ধরনের কোষ আছে, প্রতিটির আলাদা কাজ। কোনো জিনের মিউটেশন এক অঙ্গে ক্যানসার ঝুঁকি কমালেও অন্য অঙ্গে কোনো প্রভাব নাও ফেলতে পারে। এই জটিলতা বোঝার জন্য ব্যাপক গবেষণা দরকার।
বর্তমানে CRISPR প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত হাজারো জিন পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে, যা গবেষণাকে অনেক এগিয়ে দিয়েছে।
পরিবেশ ও বাহ্যিক ঝুঁকি
কোষের ত্রুটিপূর্ণ ডিএনএ সবসময় টিউমার তৈরি করে না। পরিবেশগত কারণ বড় ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, শহরের বায়ুদূষণ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রসাধনী বা পানির দূষণে থাকা রাসায়নিকও ক্ষতিকর হতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যালান বালমেইনের মতে, মানুষের পরিচিত ২০টি ক্যানসার-সৃষ্টিকারী রাসায়নিকের মধ্যে মাত্র ৩টি সরাসরি মিউটেশন ঘটায়। বাকিগুলো অন্যভাবে টিউমার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

প্রদাহ: ক্যানসারের জ্বালানি
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন ক্যানসার-ঝুঁকিপূর্ণ কোষকে সক্রিয় করে তোলে। বায়ুদূষণ, এসিড রিফ্লাক্স, অতিবেগুনি রশ্মি কিংবা দীর্ঘস্থায়ী ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ শরীরে প্রদাহ বাড়ায়, যা শেষে টিউমারে রূপ নেয়।
২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের দূষিত বায়ু ধূমপান না করা মানুষের ফুসফুস ক্যানসার ঘটাতে পারে। মাত্র তিন বছর দূষিত এলাকায় থাকলেই ঝুঁকি বাড়ে।
ভবিষ্যতের প্রতিরোধ কৌশল
এখন চিকিৎসকেরা ভাবছেন, শুধু মিউটেশন নয় বরং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণই ক্যানসার প্রতিরোধের কার্যকর উপায় হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় দেখা গেছে ইন্টারলিউকিন-১β নামক প্রোটিন প্রদাহ বাড়িয়ে টিউমার তৈরি করে। এ প্রোটিন বন্ধ করতে সক্ষম ওষুধ পরীক্ষায় ক্যানসার রোধ করেছে।

এ ধরনের ওষুধ বিশেষত উপকারে আসবে যাদের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেশি—যেমন জেনেটিক সমস্যায় ভুগছেন, ধূমপান করেছেন, আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন অথবা দেহে প্রি-ক্যানসারাস টিস্যু রয়েছে।
মানুষের আয়ু বাড়ছে, আর ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ছে। তাই নতুন প্রতিরোধমূলক ওষুধ কোটি মানুষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















