গ্রামীণ মায়েদের জন্য বিশেষ রান্না শেখানো হচ্ছে
সুজাওয়াল, পাকিস্তান—ক্ষুধার্ত শিশুকে কোলে নিয়ে একদল মা সেমাই দিয়ে খাবার রান্না করছেন প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। ইউনিসেফের পুষ্টি কর্মসূচির আওতায় এই উদ্যোগের লক্ষ্য শিশুপুষ্টিহীনতা রোধ করা। পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় অর্ধেক শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
শহর-গ্রামের বৈষম্য
সিন্ধ প্রদেশে করাচির মতো বন্দরনগরী থাকলেও কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে গ্রামীণ এলাকায় শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষীণকায় ও খর্বকায় হয়ে পড়ছে। শুষ্ক গ্রামে তপ্ত রোদে ক্লান্ত-অবসন্ন শিশুরা বসে থাকে, আর সমাজকর্মীরা মায়েদের পুষ্টিকর খাবারের উপকরণ সম্পর্কে শেখাচ্ছেন।

অভ্যাস বদলের গল্প
২৫ বছরের শাহনাজ আগে শুধু আলু দিয়েই সন্তানদের খাওয়াতেন। ছয় সন্তানই ছিল দুর্বল ও অসুস্থ। এক বছর প্রশিক্ষণের পর তিনি এখন ডাল ও সেমাইয়ের মতো সাশ্রয়ী খাদ্য ব্যবহার করছেন। এতে তার মেয়ের অপুষ্টি কেটে গেছে।
ভয়াবহ পরিসংখ্যান
জাতীয় জরিপ অনুযায়ী, সিন্ধ প্রদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৮ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ২০ শতাংশ ভয়াবহ খর্বতায় আক্রান্ত।
সহজলভ্য খাবার নিয়ে শিক্ষা
সামাজিক কর্মী আজমা মায়েদের বোঝাচ্ছেন—সেমাই বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। মাত্র ৫০ রুপিতে (প্রায় ২০ সেন্ট) এক সপ্তাহ পর্যন্ত ছয় মাস বয়সী শিশুকে খাওয়ানো সম্ভব। ইউনিসেফের উদ্যোগে ইতিমধ্যে ৩৫০০ মা এই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।

করুণ অভিজ্ঞতা
২৩ বছরের কুলসুম, গর্ভে ষষ্ঠ সন্তান, আগে বাচ্চাদের শুধু ভাজা রুটি খাওয়াতেন। একজন সন্তান মারা গেছে, আরেকজন খুবই দুর্বল। তাই তিনি এই ক্লাসে যোগ দিয়েছেন।
খাদ্য বৈচিত্র্যের অভাব
ডা. মাজহার ইকবাল, ইউনিসেফের পুষ্টিবিদ, জানান—শিশুদের মূল সমস্যা হলো বৈচিত্র্যহীন খাদ্য। পাকিস্তানে ৩৮ শতাংশ শিশু প্রতিদিন মাত্র দুই ধরনের খাবার খায়, যেখানে ইউনিসেফ আটটি খাদ্য বিভাগ সুপারিশ করে। মাংস কেবল উৎসবে খাওয়া হয়, অথচ মুরগির ভুঁড়ি, সেদ্ধ হাড়, ডাল ও শিম সস্তায় প্রোটিন সরবরাহ করতে পারে।
ফল-সবজির ভুল ব্যবহার
ফলমূল ও সবজি সাধারণত ভেজে খাওয়া হয়, এতে পুষ্টি নষ্ট হয়। বখতাওয়ার করিম তার সন্তান অ্যানিমিয়ায় মারা যাওয়ার পর এই কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। তার এক বছরের মেয়ে খর্বতায় ভুগছে—এ গ্রামে শিশুদের ৭২ শতাংশই খর্বকায়, যা পাকিস্তানের জাতীয় গড় ৪২ শতাংশের চেয়েও ভয়াবহ।

দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি
খর্বতা শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ ও শারীরিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। পরিষ্কার পানি ও স্যানিটেশনের অভাব এ সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। এর সঙ্গে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়া ও নানা অসুখ লেগেই আছে।
মায়েদের স্বাস্থ্য সংকট
অল্প বয়সে বিয়ে ও বারবার গর্ভধারণের কারণে সিন্ধ প্রদেশে ৪৫ শতাংশ নারী অ্যানিমিয়ায় ভোগেন। এতে স্বল্প ওজনের শিশু জন্ম নেয়, যারা পরবর্তীতে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
খাদ্যসংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণা
সুজাওয়ালের মাত্র এক-চতুর্থাংশ মানুষ পড়তে-লিখতে জানে। খাবার নিয়ে নানা কুসংস্কার নারীদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত করছে। যেমন—ডিম বা শুকনো ফল খেলে মাসিকের সময় রক্তপাত বেড়ে যায়, এই ধারণা ভুল।

নারীদের প্রতি বৈষম্য
খাওয়ার সময়ে আগে পুরুষদের পরিবেশন করা হয়। নারীরা শেষে খায়—যদিও মাঠে সবচেয়ে বেশি শারীরিক পরিশ্রম করেন তারা। খাবার কম হলে সবার আগে নারীর অংশই কমিয়ে দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে অপুষ্টি শুধু শিশুরাই নয়, বরং পুরো সমাজের ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলছে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মায়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়া এ সংকট থেকে মুক্তি সম্ভব নয়।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















