গ্রামীণ আফগানিস্তানে সংকট
আফগানিস্তানের দাইকুন্ডি প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরা মাতৃত্বকালীন চিকিৎসা পাচ্ছেন না। ৪৩ বছর বয়সী ধাত্রী গুল চামান জুলাইয়ে এক নবজাতকের সেবা করতে গিয়ে বুঝলেন, তাঁর ক্লিনিকের অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চাকরি হারানোর পাশাপাশি তিনি চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন।
দীর্ঘদিনের ভরসা ভেঙে পড়ল
মেলমাস্তক গ্রামের ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি গত ১২ বছরে যুদ্ধ, তালেবান দখল এবং আন্তর্জাতিক সেনা প্রত্যাহারের পরও টিকে ছিল। এখানকার একমাত্র ধাত্রী আতিফা বহু বছর ধরে মায়েদের সহায়তা করে আসছিলেন। কিন্তু এ বছরের জুলাইয়ে ক্লিনিকটি বন্ধ হয়ে যায়। আতিফা স্পষ্ট করে বলেন, “মা ও শিশু মারা যাবে।”
এর মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা ব্যাপকভাবে কেটে দেওয়া। আগে জাতিসংঘের মাধ্যমে এ সহায়তাই আফগান জনগণের স্বাস্থ্যসেবা চালু রাখার প্রধান উৎস ছিল। আগস্ট থেকে সহায়তা কমার ফলে দেশজুড়ে ৪২২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে শুধু দাইকুন্ডি প্রদেশেই ২১টি পরিবারস্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়।

দুঃখজনক মৃত্যুর ঘটনা
এপ্রিলে আলি হাসান তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মরিয়মকে স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে আসেন। কিন্তু সেটি তখন বন্ধ। অন্য হাসপাতালে পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়। সেখানে পৌঁছানোর পরই মরিয়ম ও শিশুটি মারা যায়। জেলার ধাত্রী সেদিকা বলেন, “যদি ক্লিনিক খোলা থাকত, হয়তো মা বা শিশু দুজনকেই বাঁচানো যেত।”
বৈশ্বিক উন্নতি আর আফগানিস্তানের পশ্চাদপদতা
বিশ্বজুড়ে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ। কিন্তু আফগানিস্তান উল্টো পথে হাঁটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, সংঘাতকবলিত দেশগুলোতেই বিশ্বব্যাপী দুই-তৃতীয়াংশ মাতৃমৃত্যু ঘটে। দাইকুন্ডির ৩০ বছর বয়সী গর্ভবতী কুরশিদ বলেন, “আমরা সবাই ভয় পাচ্ছি, হয়তো আমাদের সন্তান বা আমরা নিজেরাই মারা যাব।”
শিশুদের চিকিৎসা ব্যাহত
ক্লিনিকগুলো শুধু গর্ভবতী নারীদের নয়, শিশুদের চিকিৎসাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। ২৪ বছর বয়সী মরিয়মের তিন সন্তান আছে। গত বছর তিনি পাঁচ মাস বয়সী শিশুকে হারান, কারণ নিকটবর্তী ক্লিনিকে পৌঁছাতে না পেরে শিশুটি পথেই মারা যায়। এখন তাঁর বাড়ি থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দূরত্ব আরও বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, “শীতে যখন বরফে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, তখন অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়।”
ধাত্রীদের জীবনেও বিপর্যয়
ক্লিনিক বন্ধ হওয়ায় বহু ধাত্রী কাজ হারিয়েছেন। গুল চামান বলেন, “প্রতিদিন আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমার ও আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীষণ ভয় পাচ্ছি।” আতিফা জানান, ব্যক্তিগতভাবে সেবা দেওয়ার মতো সরঞ্জামও তাঁর হাতে নেই। ফলে তাঁকে রোগীদের ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। এর ফলে সোহরা নামে এক তরুণী সন্তান হারান।

মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র
ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করা জাহিরার মতো নারীরাও চাকরি হারিয়েছেন। তিনি নিজে পাঁচ সন্তানের মা এবং সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন।
ধাত্রী গুলসুম আকবারি জানান, এক গর্ভবতী নারী দূরবর্তী এলাকা থেকে এসে তাঁর ক্লিনিকে মৃত শিশু প্রসব করেন। তিনি বিশ্বাস করেন, নিকটবর্তী বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্লিনিক চালু থাকলে হয়তো শিশুটি বাঁচানো যেত।
২৫ বছর বয়সী মেহাফরোজ এখন সন্তান প্রসব নিয়ে আতঙ্কে আছেন। তাঁর স্থানীয় ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, “আমি দুর্বল, এতদূর হেঁটে যেতে পারব না। আমি আর আমার সন্তানের কী হবে জানি না।”
স্থানীয়দের আবেদন
গ্রামপ্রধান মোহাম্মদ নাদির শরিফি স্থানীয় কাউন্সিলের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষকে আবেদন জানিয়েছেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্লিনিকগুলো আবার খুলে দেওয়ার জন্য।
একজন মা, মহওয়াশ, নিজের মৃত শিশুর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “অনেক নারী তাঁদের সন্তান হারাবেন। আমার আবেদন, দয়া করে এই ক্লিনিকগুলো আবার খুলে দিন।”
মার্কিন সহায়তা বন্ধ হওয়ার কারণে আফগানিস্তানে বিশেষ করে নারীদের জন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। যেখানে বিশ্বজুড়ে মাতৃমৃত্যুর হার কমছে, সেখানে আফগানিস্তান আবার মৃত্যুর পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এক ধাত্রী আতিফার কথাই পরিস্থিতির সারাংশ তুলে ধরে:
“ক্লিনিকগুলো বন্ধ থাকলে নারী আবার ঘরে সন্তান প্রসব করবে, আর হয়তো মা কিংবা শিশু—কেউই বাঁচবে না।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















