বাংলাদেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। এটি একদিকে যেমন উন্নয়ন অর্জনের স্বীকৃতি, অন্যদিকে নতুন অর্থনৈতিক ও নীতিগত চ্যালেঞ্জও বয়ে আনবে। নিচে বিভিন্ন খাতে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হলো—
বাণিজ্যিক সুবিধা হারানো
এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ যে বিশেষ শুল্কমুক্ত ও কোটা-মুক্ত সুবিধা ভোগ করছে, তা ধীরে ধীরে কমে যাবে। ফলে তৈরি পোশাকসহ প্রধান রপ্তানি খাত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় দুর্বল হতে পারে।
রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা
ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশ উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা প্রতিযোগিতাকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
বিনিয়োগ আকর্ষণ
বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি হবে। কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তি-অভিযোজনের ঘাটতি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করতে পারে।
আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা হ্রাস
এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ আর স্বল্পসুদে ঋণ বা অনুদান-ভিত্তিক অনেক সহায়তা পাবে না। এর পরিবর্তে উচ্চ সুদের বাণিজ্যিক ঋণের দিকে ঝুঁকতে হতে পারে, যা ঋণসঙ্কটের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
কৃষি ও শ্রমবাজারের চাপ
প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর হলে অদক্ষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সংকট তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে কৃষি খাতে আধুনিকায়ন ও বাজার-সুবিধা না বাড়লে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
সামাজিক সুরক্ষা ও বৈষম্য
অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনে আয়ের বৈষম্য বাড়তে পারে। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী না হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত চাপ তৈরি করবে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিবেশবান্ধব কৌশল না নিলে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এলডিসিতে উত্তরণের পর বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জগুলো
সারাক্ষণ রিপোর্ট
বাংলাদেশ শিগগিরই স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণের পথে রয়েছে। এটি একদিকে দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রচেষ্টার স্বীকৃতি, অন্যদিকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার পূর্বাভাস। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি, নীতি, সমাজ এবং পরিবেশ—এই চারটি স্তম্ভে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। নিচে সেগুলো ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করা হলো।
১. অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপানসহ উন্নত দেশগুলোতে শুল্কমুক্ত ও কোটা-মুক্ত সুবিধার কারণে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাত বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু উত্তরণের পর এসব সুবিধা ধীরে ধীরে কমে যাবে।
এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে বাড়তি প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলো ইতিমধ্যেই কম উৎপাদন ব্যয় ও প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন দিয়ে জায়গা দখল করছে। এছাড়া বাংলাদেশের অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, জ্বালানি ঘাটতি এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিও প্রতিযোগিতা দুর্বল করতে পারে।
এছাড়া এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ আর স্বল্পসুদে ঋণ পাবে না। বাধ্য হয়ে বেশি সুদের বাণিজ্যিক ঋণ নিতে হলে ঋণের চাপ বাড়তে পারে, যা সামগ্রিক অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
২. নীতিগত চ্যালেঞ্জ
অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখতে নীতিগত সংস্কার অপরিহার্য হবে। প্রথমত, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (FDI) আনার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বচ্ছ আইনি কাঠামো, দ্রুত বিচারব্যবস্থা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, রপ্তানি খাতকে বৈচিত্র্যময় করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক থেকে আসে। এই নির্ভরতা কমিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি, ফার্মাসিউটিক্যালস, কৃষিজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ প্রভৃতি খাতকে এগিয়ে নিতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে (R&D) বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নীতি সংস্কার ছাড়া এলডিসি-পরবর্তী অর্থনৈতিক রূপান্তর স্থায়ী হবে না।
৩. সামাজিক চ্যালেঞ্জ
অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন সরাসরি সমাজে প্রভাব ফেলবে। শ্রমবাজারে সবচেয়ে বড় চাপ পড়বে অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিকদের ওপর। প্রযুক্তি-নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর হলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কর্মসংকটে পড়তে পারেন। ফলে নতুন দক্ষতা অর্জন ও প্রশিক্ষণের সুযোগ তৈরি করা জরুরি হবে।
এছাড়া আয়ের বৈষম্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শহর ও গ্রামের মধ্যে, কিংবা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয় ও সুযোগের পার্থক্য বাড়লে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি (Social Safety Net) আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বাদ না পড়ে। অন্যদিকে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
৪. পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের জন্য গুরুতর হুমকি। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা ঘন ঘন হওয়া, নদীভাঙন ও ভূমি হারানো কোটি মানুষের জীবনকে অনিশ্চয়তার মুখে ফেলছে।
এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে জলবায়ু অভিযোজন তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা হারাতে পারে। ফলে দেশকে নিজের অর্থনৈতিক সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে টেকসই পরিবেশনীতি গড়ে তুলতে হবে।
পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা না আনতে পারলে উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে না।
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ নিঃসন্দেহে গৌরবের বিষয়, কিন্তু এই অর্জন ধরে রাখতে হলে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া অপরিহার্য। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখা, নীতিগত সংস্কার, সামাজিক সুরক্ষা বিস্তৃত করা এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে টেকসই অগ্রযাত্রা বজায় রাখতে পারবে।