বাংলাদেশে মিথ্যা, হয়রানিমূলক মামলা চলছে অবিরাম। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময়ের হত্যাকাণ্ডে জড়ানো মিথ্যা মামলার জোয়ারে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে আরো বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা।
সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খানকে গত ৭ সেপ্টেম্বর আটক করে শাহবাগ থানায় গত ২৮ আগস্ট দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি সংগঠনের আয়োজন করা মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান বিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ তুলে আলোচনাসভায় উপস্থিত ১৬ জনকে কারাগারে পাঠানো হয়। এক জামায়াত নেতার উপস্থিতিতে কিছু লোক মব সন্ত্রাস চালিয়ে যথাযথ অনুমতি সাপেক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি পণ্ড করলেও পুলিশ প্রকাশ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠান পণ্ডকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টর বাদী হয়ে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠায়। তাদের কেউ এখনো জামিন পাননি। পরে আটক করে একই মামলায় জড়ানো আবু আলম মহীদ খানও জামিন পাননি এখনো।
মামলার নেপথ্যের কারণ টকশোতে কথা বলা?
আবু আলম মহীদ খানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ওবায়দুল ইসলাম ডয়চে ভেলকে বলেন, ” রিপোর্টার্স ইউনিটির ঘটনায় তাকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তিনি ওখানে উপস্থিতও ছিলেন না। এজাহারেও তার নাম নেই। আসলে তিনি টকশোতে কথা বলেন, তাই টকশো থেকে বিরত রাখতে তাকে আটক করে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। রবিবার জামিনের আবেদন করেছিলাম। জামিনও দেয়নি আদালত।”
তার কথা, ” আসলে এখন কাকে কোন মামলায় দেবে তা তো বলা কঠিন। যাকে যে মামলায় দিলে সুবিধা হয়, তাকে সেই মামলা দেয়া হয়। গ্রেপ্তার করে মতিঝিল থেকে, মামলা দেয় মিরপুরে।”
“সন্ত্রাস দমন আইনের কোনো উপাদানই ওই মামলায় নেই। একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে দিনের বেলা কীভাবে রাষ্ট্রবিরোধী এবং সরকার পতনের ষড়যন্ত্র করা হয় আমি বুঝি না। আর ওই অনুষ্ঠানের তো অনুমতি নেয়া ছিল ডিএমপি থেকে,” বলেন তিনি।
ফুল দিতে গিয়ে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হন রিক্সাচালক
গত ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আটক হন রিকশা চালক আজিজুর রহমান। হাতের ফুল কেড়ে নিয়ে তাকে মারপিট করা হয়। কিন্তু হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ওই রিক্সা চালককেই জুলাই-আগস্টের ঘটনায় চলতি বছরের এপ্রিলে দায়ের করা একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় ধানমন্ডি থানা পুলিশ। ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে ১৭ আগস্ট আদালত থেকে জামিন দেয়।
রিকশা চালক মো. আজিজুর রহমানকে যে মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে, ওই মামলাটি দায়ের হয় চলতি বছরের ২ এপ্রিল। মামলার বাদী আরিফুল ইসলাম মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে স্নাতকের শিক্ষার্থী। তিনি জানান, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট তিনি সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি কামরাঙ্গীরচর এলাকায় থাকেন। আরিফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন,” আমি নিজে মামলাটি করিনি। আমাদের এলাকার মনি চেয়ারম্যান অনুদানের কথা বলে আমার কাছ থেকে একটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন। পরে জানতে পারি মামলা হয়েছে এবং আমিই সেই মামলার বাদী।’
তিনি আরো বলেন, “এই মামলাটি দিয়ে অনেককে হয়রানি করা হচ্ছে বলে আমি বুঝতে পারছি। মামলা-বাণিজ্য করা হচ্ছে। কারণ, আমি প্রায়ই ফোন পাই। কিন্তু আমি কিছু জানি না। ওই রিকশা চালককে ছাড়ানোর বিষয়ে আমার কিছু করার থাকলে আমাকে বলবেন। আমি সহায়তা করবো।”
গত ফেব্রুয়ারিতে মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এক প্রতিবেদনে জানায়, তারা জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ের ৮৮১ জন শহিদের পরিবারে সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখেছেন তাদের মধ্যে ৩০০ শহিদের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে।
তবে এমন নজিরও আছে যে, পরিবার মামলা না করলেও অন্যরা বাদী হয়ে মামলা করেছে।
আওয়ামী লীগ নেতা ‘বানিয়ে’ মামলা
মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ নামে একজন গাড়ি চালক গত বছরের ১৯ জুলাই উত্তরায় নিহত হন । তার স্ত্রী ফারজানা বেগম জানান, ওই ঘটনায় তিনি মামলা করতে পারেননি। তার শাশুড়িকে ( আসাদুল্লাহর মা ) নিয়ে গিয়ে মামলা করায় কিছু লোক। ফারজানা বলেন, “মামলায় কতজন আসামি, কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা তার কিছুই আমি জানি না। আসলে এই মামলার ব্যাপারে আমরা কোনো খবর এখন আর রাখি না । যারা মামলা করিয়েছে, তারাই জানেন মামলা নিয়ে কী হচ্ছে,” বলেন তিনি।
এইসব মামলাকে পুঁজি করে ব্যবসা দখলেরও অভিযোগ আছে। ঢাকার উত্তরায় পত্রিকার বিক্রির ব্যবসা করেন (হকার) মো. রুস্তুম আলী। তার একটি সেন্টার আছে সেখানে। তিনি অভিযোগ করেন, “শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর জুলাই আন্দোলনের একটি হত্যা মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমি এক মাস আগে জামিনে ছাড়া পেয়েছি।”
তার কথা, ” আমার বাসা বাড্ডা, ব্যবসা করি উত্তরায়। আর আমাকে হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বানিয়ে ওই থানার মামলায় আসামি করা হয়েছে। মোট আসামি দুইশ’র বেশি। আমি কোনো দিন রাজনীতি করিনি।” তিনি আরো জানান, ‘‘মামলার বাদী ঢাকার বাইরে বসবাসরত। ওই একই ঘটনায় আবার নিহতের পরিবার ধানমন্ডি থানায়ও একটি মামলা করেছে। সেখানে আমি আসামি না।”
“এখন আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থানীয় বিএনপির কিছু লোকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। যেহেতু আমি হকার, তাই ব্যবসা তো তারা করতে পারে না। ব্যবসা আমাকে দিয়েই করায়, কিন্তু মাসে তাদের এক লাখ টাকা দিতে হয়।”
জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদলের এক নেতার পরিবারের সদস্যরাও এই ধরনের মামলার আসামি হয়েছেন। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রকি ভূঁইয়ার পরিবারের কয়েকজন সদস্য এখন জুলাই হত্যা মামলার আসামি। রকি ডয়চে ভেলেকে বলেন,” আসলে রজনীতি নিয়ে গ্রুপিং এবং চাঁদাবাজি করতে আমার ছোট ভাইসহ স্থানীয় আরো আট জন বিএনপির লোককে আসামি করা হয়েছে।”
” গত বছরের চার আগস্ট আমাদের উপজেলায় সরকার পতনের আন্দোলনে যে দুইজন নিহত হওয়ার কথা এজাহারে বলা হয়েছে, তারা আসলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। মেডিকেল প্রতিবেদনেও তাই আছে,” দাবি তার।
অন্যদিকে যারা অপরাধ করেছে, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।
হামলায় নিহত হওয়া নিহতের ‘অপরাধ’?
৯ আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে হত্যার ঘটনায় করা মামলার এজাহার পুলিশ উদ্দেশ্যমূলকভাবে পাল্টে দিয়েছে বলে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন। রূপলালের মেয়ে নূপুর দাসের অভিযোগ “পুলিশ সব দোষ আমার বাবার ঘাড়েই চাপিয়েছে। আমার বাবা নাকি নিজের কারণেই মারা গেছে। এখন তো আর উনি বেঁচে নাই। ওনাকে দোষ দিলে উনি তো আর প্রতিবাদ করতে পারবেন না। ঘটনার পরের দিন আমার বিয়ের তারিখ ঠিক করতে যাওয়ার কথা ছিল। তাদের ব্যাগে পানীয় ছিল, যেটা আমাদের বিয়ে-শাদীতে খায়। কিন্তু ব্যাগে আপেল, কমলা, ডালিম, পেয়ারা মিষ্টিও ছিল। সেগুলো নিয়ে গেছে। এজাহারে ওই ফল ও মিষ্টির কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে, ব্যাগে দুর্গন্ধযুক্ত পানীয় এবং ঔষধ পায়। কয়েকজন তাদের আটকে তা পান করলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং উত্তেজিত জনতা তাদের (রূপলালদের) গণপিটুনি দেয় বলে দাবি করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
গত ৫ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়, কবর থেকে তুলে পোড়ানো হয় নুরা পাগলার লাশ৷ সেই ঘটনায় মূল আসামিদের আড়াল করার অভিযোগ উঠেছে। যারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে হামলা করেছে , যেসব রাজনৈতিক দলের (মূলত স্থানীয় বিএনপি ও জামাত) নেতারা প্রকাশ্যে ইন্ধন দিয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় না এনে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মী ও অন্য নিরীহ ব্যক্তিদের আটকের অভিযোগ উঠেছে৷
মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন,” অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বার বার মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার ব্যপারে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে আমরা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখছি না। উল্টো যারা মবের শিকার, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। পুলিশও উদ্দেশ্যমূলক মামলা করছে। আর মামলগুলোতে শত শত আসামি করা হচ্ছে। অজ্ঞাত আসামি করা হচ্ছে। মামলাকে কেউ কেউ ব্যবসায় পরিণত করেছে। মামলা করার আগেও চাঁদার হুমকি দেয়া হচ্ছে। আবার চাঁদা না পেলে মামলা করা হচ্ছে। মামলার পর নাম বাদ দেয়ার জন্যও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।”
“আপনি অবাক হবেন, চাঁদার জন্য সলিমুল্লাহ এতিম খানার তত্ত্বাবধায়কের বিরুদ্ধে দেশের তিন জায়গায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। তাকে জেলেও যেতে হয়েছে। অনেক মামায় এমন আসামি করা হচ্ছে, যারা ওই জায়গায় ছিলেনই না। ঘটনা ধানমণ্ডির, আসামী মিরপুরের,” বলেন তিনি।
আর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন,” আসলে এইসব মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। সরকার বললেও কোনো কার্যকর পক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। ফলে এখন মামলা চাঁদাবজি এবং রাজনৈতিক হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।”
সরকার অবশ্য এই ধরনের মামলা থেকে রেহাই দিতে সম্প্রতি ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করেছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩(ক)/১৭৩(অ) এ নতুন বিধানটি যুক্ত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পুলিশ কমিশনার, এসপি বা কোনো জেলার এসপি পদমর্যাদার কোনো পুলিশ কর্মকর্তার এখতিয়ারাধীন কোনো মামলার বিষয়ে তিনি যৌক্তিক মনে করলে তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর সেই মামলার তদন্তের ব্যাপারে প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিতে পারবেন। ম্যাজিস্ট্রেট তার বিবেচনাবলে নিরপরাধ ও যার বিরুদ্ধে ওই অপরাধের কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই, তাদের বিচার পূর্ববর্তী পর্যায়েই মামলা থেকে রেহাই দিতে পারবেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা মামলাগুলো মনিটরিং করছি। চার্জশিটে যাতে নিরপরাধ কেউ না থাকে, সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারী করা হচ্ছে। আর নতুন করে যাতে কোনো হয়রানিমূলক মামলা না হয়, নিরীহ কাউকে যেন আসামি করা না হয় সেই নির্দেশনা পুলিশের প্রত্যেক ইউনিটকে দেয়া হয়েছে।”
আর প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারি প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেন,” এরই মধ্যে মিথ্যা ও হয়রানীমূলক মামলা প্রতিরোধে আমরা আইন সংশোধন করেছি। আর মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের তালিকা করা হচ্ছে। এটা প্রক্রিয়াধীন। এরই মধ্যে ৩০ জনের মতো ব্যক্তিকে এই ধরনের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়া চলবে।”