যুদ্ধ আর জলবায়ুর ধাক্কা, তবুও দাম কমছে
তিন বছর আগে পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বিশ্বে দুই বড় শস্য রপ্তানিকারকের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধায়। একই সময়ে বিশ্বের নানা শস্যভাণ্ডার খরায় বিপর্যস্ত হয়। গমের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায়, ভুট্টা ও সয়াবিনের দামও বাড়তে থাকে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দাম কমতে শুরু করে এবং তা আজও নামছে। এখনকার দাম প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে।
অবস্থা অদ্ভুত। ইউক্রেনের যুদ্ধ থামেনি, দেশটির কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতির মুখে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশটি এ মৌসুমে রপ্তানি ২৫-৩০ শতাংশ কমাতে বাধ্য হবে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, আর আমেরিকার শুল্কনীতির কারণে বাণিজ্যে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। গমের মজুতের মতো অনেক সূচকই বছরের পর বছর বিপদের সংকেত দিচ্ছে। তবুও বাজার কেন এত স্থিতিশীল?
উৎপাদনের জোয়ারে দামপতন
মূল কারণ হলো বৈশ্বিক উৎপাদনের উত্থান। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে রাশিয়া—বিশ্বের সবচেয়ে বড় গম রপ্তানিকারক—ক্রমাগত ভালো ফসল তুলছে। অস্ট্রেলিয়াও গত দুই মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ গম উৎপাদন করেছে। ইউরোপের ফলনও আশাজাগানিয়া।
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে অন্য শস্যেও। আমেরিকা এ মৌসুমে রেকর্ড ভুট্টা উৎপাদনের পথে। প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে। এর ফলে পশুখাদ্যে ব্যবহৃত গম ও সয়াবিনের দামও কমছে।
চাহিদা কম, নীতিতে পরিবর্তন
অন্যদিকে চাহিদা দুর্বল। নিজস্ব কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে চীন ভুট্টা আমদানি নাটকীয়ভাবে কমিয়ে এনেছে—২০২৩-২৪ মৌসুমে ২ কোটি ৩০ লাখ টন থেকে এবার মাত্র ৪০ লাখ টন। মধ্যপ্রাচ্যের মতো অন্য আমদানিকারক দেশগুলোও নিজেদের কৃষি ও খাদ্যশিল্পকে রক্ষায় আমদানি কমিয়েছে।
বাজারের কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে। আমদানিকারকরা এখন আগের তুলনায় কম মজুতে ভরসা রাখতে শিখেছে। বড় সরবরাহকারীদের উত্থান—যেমন রাশিয়া—তাদের আশ্বস্ত করছে যে বৈশ্বিক বাজারে সরবরাহ পাবে। ২০২২ সালে যে শস্য সংকট দ্রুত কেটে গিয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতাও তাদের আস্থা জুগিয়েছে।
বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব
তবে চিত্র পুরোপুরি সহজ নয়। গত বছর আগস্টে চীন ১ কোটি ৩০ লাখ টন আমেরিকান সয়াবিন বুকিং করেছিল, এবার এখনো একটিও করেনি। ডলার দুর্বল হওয়ায় আমেরিকান ভুট্টা তুলনামূলক সস্তা হয়ে গেছে, ফলে দ্রুত বিক্রি হচ্ছে। এতে আঞ্চলিক দামের তারতম্য ঘটছে, তবে মোট বাণিজ্য কমছে না।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অস্থির অর্থনৈতিক নীতিই দাম আরও কমাচ্ছে বলে ধারণা। হঠাৎ নীতি পরিবর্তনের আশঙ্কায় আমেরিকান কৃষকেরা রপ্তানি আগেভাগেই করছে—যা সাধারণত রাশিয়ায় দেখা যায়। অনিশ্চয়তা আর উচ্চ সুদহার বিনিয়োগ তহবিলকে পণ্যবাজার থেকে সরিয়ে অন্য খাতে নিয়ে গেছে। যারা রয়ে গেছে, তারা শস্যদামের পতনের দিকেই বাজি ধরছে। এ বছর মে মাসে রেকর্ড ছুঁয়ে আসা শিকাগো গম বাজারে “শর্ট” অবস্থান এখনও বেশি।
বিপদের সম্ভাবনা সামনে
তবে কি সবকিছু এত সহজ? দাম উৎপাদন খরচের নিচে নেমে যাওয়ায় কৃষকেরা হয়তো কম বপন করবে। অথচ বৈশ্বিক জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি ধনী হচ্ছে। মাত্র এক দশকে ভুট্টা খাওয়ার হার বেড়েছে ২৮ শতাংশ, সয়াবিন ৩৮ শতাংশ।
বিশ্বের প্রধান রপ্তানিকারকদের গম মজুত বৈশ্বিক ভোগের তুলনায় নেমে আসছে ২০০৭-০৮ সালের সংকট সময়ের কাছাকাছি। তখন খাদ্য সংকট ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। কোনো এক মৌসুমের বড় খরা দামকে মুহূর্তে উড়িয়ে দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আইএফপিআরআই-এর জো গ্লাবার। তাই আমদানিকারকদের উচিত এই সস্তা বাজারে যতদিন সম্ভব সুবিধা নেওয়া।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















