মার্কিন বন্ডবাজারে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ফেরার পর এই প্রথম মনে হচ্ছে ফেডারেল রিজার্ভ তাঁর ইচ্ছার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে। আগস্টে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য প্রকাশের পর ট্রাম্প আবারও সুদের হার কমানোর দাবি জানান। ১০ দিন পর ফেড প্রধান জেরোম পাওয়েল ওয়াইয়োমিংয়ের জ্যাকসন হোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের বার্ষিক সম্মেলনে ইঙ্গিত দেন যে সুদের হার কমানো হতে পারে। সেপ্টেম্বর ১৬-১৭ তারিখে নীতিনির্ধারণী বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে বলে বাজারে প্রায় নিশ্চিত ধরা হচ্ছে। প্রশ্ন শুধু—হার কতটা কমবে: ০.২৫ নাকি ০.৫ শতাংশ।
দ্বন্দ্বে ফেডের লক্ষ্য
পাওয়েলের বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে, শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান হ্রাস পাচ্ছে এবং এই অবস্থায় অর্থনীতিকে চাঙা করতে ফেড সুদের হার কমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো, একই সময়ে মুদ্রাস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার উপরে রয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের ঝুঁকি তৈরি করছে। কম সুদ হয়তো কর্মসংস্থান বাড়াতে সাহায্য করবে, কিন্তু এতে আবারও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতি সূচক ও ভোক্তাদের প্রত্যাশা
জুলাই পর্যন্ত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভোক্তা মূল্যস্ফীতি (খাদ্য ও জ্বালানি বাদে) দাঁড়িয়েছে ৩.১ শতাংশে। আগস্টেও এ হার অপরিবর্তিত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, অর্থাৎ মার্চের পর থেকে তেমন কোনো পতন হয়নি। ফেডের পছন্দের সূচক—ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয় সূচকে (PCE)—মুদ্রাস্ফীতি ২০২১ সালের শুরু থেকে নির্ধারিত ২ শতাংশের বেশি রয়েছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ অনুযায়ী, ভোক্তারা আগামী এক বছরে মুদ্রাস্ফীতি ৪.৮ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদে ৩.৫ শতাংশ হবে বলে ধারণা করছেন।
শেয়ার ও স্বর্ণবাজারের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া
শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা খুব একটা আতঙ্কিত নন; বরং সূচক প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নতুন রেকর্ড গড়ছে। কিন্তু স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চে পৌঁছে প্রতি ট্রয় আউন্সে ৩,৬০০ ডলারের ওপরে গেছে, যা মুদ্রাস্ফীতি ও অস্থিতিশীলতার ভয়ে আশ্রয় খোঁজার ইঙ্গিত। অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি বন্ডধারীরা কয়েক মাস ধরে অস্থির। ব্যাঙ্ক অব আমেরিকার সাম্প্রতিক জরিপে ৪৭ শতাংশ ফান্ড ম্যানেজার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন হয় ‘মুদ্রাস্ফীতি ফেডকে সুদ কমাতে দেবে না’ অথবা ‘বন্ড আয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি’।
ঘাটতি ও বন্ডবাজারের ভয়
আমেরিকার আর্থিক ঘাটতি বর্তমানে জিডিপির ৭ শতাংশ। এ ঘাটতি বাড়লে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। এতে ফেড সুদ যতটা কমাতে চাইছে, ততটা কমাতে পারবে না এবং বন্ডের আয় বাড়তে থাকবে। আবার যদি কর্মসংস্থানের পক্ষে সুদ কমানো হয়, তবে তা উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিকে স্থায়ী করে ফেলতে পারে, ফলে বন্ডের প্রকৃত মূল্য কমে যাবে। আরও একটি বড় ভয় হলো—আমেরিকার বিশাল ঋণভার। ঋণের প্রকৃত বোঝা কমাতে মুদ্রাস্ফীতিকে ‘ছেড়ে দেওয়া’ হতে পারে একটি অবলম্বন। এতে বন্ডবাজারে আস্থাহীনতা দেখা দিলে আয়ের হার হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে।
ভবিষ্যতের নীতি ও ঝুঁকি
ব্যাঙ্ক অব আমেরিকার জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকেরও বেশি ফান্ড ম্যানেজার মনে করছেন, ফেডের পরবর্তী প্রধান হয়তো ঋণের চাপ কমাতে আবারও বৃহৎ আকারে বন্ড কেনা বা ‘ইয়িল্ড-কার্ভ কন্ট্রোল’ নীতি চালু করবেন। অতীতে জাপানসহ উন্নত দেশগুলো এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল যখন সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সময় এমন কৌশল ব্যবহার করলে ঋণখরচ কম রাখা সম্ভব হলেও দামের লাগামছাড়া বৃদ্ধি ঘটতে পারে।
বাজারে অনিশ্চয়তা
অনেকে হয়তো এসব আশঙ্কাকে অবাস্তব ভাবতে পারেন, কিন্তু বাজারে প্রত্যাশাই বাস্তবতা তৈরি করে। যদি বিনিয়োগকারীরা মনে করেন অন্যরা আতঙ্কিত হয়ে বন্ড বিক্রি করবে, তবে তারাও আগে থেকেই বিক্রি শুরু করবেন, আর সেখান থেকেই বাজারে ধস নামতে পারে। একইভাবে আশঙ্কা রয়েছে, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ফেডের স্বাধীনতা খর্ব করতে সক্ষম হবেন। আপাতত বিনিয়োগকারীরা কম সুদের সম্ভাবনায় খুশি হলেও দীর্ঘমেয়াদে তাদের উদ্বেগ বাড়ছে।