চিংড়ির সংকট থেকে উত্তরণের পথে খুলনা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা একসময় ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত চিংড়ি রফতানির জন্য বিখ্যাত ছিল। তবে প্রতিবেশী দেশে ভ্যাননামি চিংড়ি চাষের প্রসার ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার কারণে এ খাত দীর্ঘ সময় ধরে মন্দার মধ্যে পড়ে।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মৎস্য অধিদপ্তরের নেওয়া নানা পদক্ষেপে আবারও চিংড়ি শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এ খাত পুনরুজ্জীবনের আভাস দিচ্ছে।
রফতানি আয় ও লক্ষ্যমাত্রা
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ বছরে খুলনা থেকে চিংড়ি রফতানি হয়েছে প্রায় ১১,৩০০ কোটি টাকার। এখন কর্তৃপক্ষ আগামী পাঁচ বছরে এই আয় দ্বিগুণ করে ২২,৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২০-২০২৫ অর্থবছরে খুলনা অঞ্চল থেকে মোট ১,৫৩,৩৮৮ মেট্রিক টন মাছ রফতানি হয়েছে, যার মধ্যে ১,০২,৩৩৯ টন চিংড়ি রফতানি করেই এসেছে ১১,৩০১ কোটি টাকা।
শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে খুলনায় ১,২৩,১৫১ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯,৫১২ টন রফতানি করে আয় হয়েছে ২,৪৯৯ কোটি টাকা। এ সময় চিংড়ি রফতানি হার ছিল ৪২.১৯ শতাংশ।
কৃষকদের জন্য উদ্যোগ
খুলনা মৎস্য অফিস উৎপাদন বাড়াতে বেশ কিছু কৌশলগত উদ্যোগ নিয়েছে।
- ১০,৭৫০ কৃষককে আধুনিক চিংড়ি চাষের প্রশিক্ষণ
- ৭,৫০০ জনকে যন্ত্রপাতি সরবরাহ
- ক্লাস্টারভিত্তিক চাষে উৎসাহ, যাতে কৃষকরা দ্বিগুণ থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত ফলন পেতে পারেন
এছাড়া ‘ফিল্ড ডে’ আয়োজনের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। মান উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যবিধি ও বায়োসিকিউরিটি মানা হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দাম পাওয়ার জন্য কৃষকদের তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেশন নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
নীতিগত সহায়তার প্রয়োজনীয়তা
খুলনার বিভাগীয় মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা লিপটন সরদার বলেন, চিংড়িকে ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের পাশাপাশি আলাদা নীতিমালা জরুরি।
তার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে:
- চিংড়ি চাষের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করা
- অবকাঠামো উন্নয়ন
- রোগমুক্ত রেণু ও মানসম্মত খাদ্যের সময়মতো সরবরাহ
- ফিড, ওষুধ ও রাসায়নিকের কঠোর মান পরীক্ষা
- উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণে বিশেষ জনবল কাঠামো তৈরি
তিনি বলেন, চিংড়ি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতা গড়ে তোলা এবং রফতানিকারকদের দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা দরকার। তবেই বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা ফেরানো সম্ভব হবে।
রফতানিকারকদের দৃষ্টিভঙ্গি
ফ্রোজেন ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি তারিকুল ইসলাম জাহির জানান, একসময় খুলনায় ৬৩টি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা ছিল। উৎপাদন কমে যাওয়া এবং বৈশ্বিক বাজার সংকটের কারণে এর মধ্যে ৩৩টি বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ব্যাংকের উচ্চ সুদহার ও বিদ্যুতের বাড়তি বিলের পরও কিছু প্রতিষ্ঠান টিকে আছে। খাতটি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এজন্য তিনি বিদ্যুৎ ও উৎপাদন খরচে ভর্তুকি দেওয়ার আহ্বান জানান।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
রফতানিকারকরা জানান, চিংড়ি এখনো জাতীয় অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে ইউরোপীয় বাজারে চাহিদা ও দামের পতন, বিদেশি ক্রেতাদের অনিয়মিত অর্থপ্রদান এবং ভাইরাসজনিত রোগ উৎপাদনে বড় ধাক্কা দিয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। অনেক রফতানিকারক বারবার চালান বাতিলের কারণে প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলেন।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে রফতানি বৃদ্ধির ফলে আবারও আশার সঞ্চার হয়েছে।
আগামীর দিশা
খুলনার অংশীজনরা মনে করেন, সরকারী নীতিগত সহায়তা ও উন্নত উৎপাদন মান অব্যাহত থাকলে চিংড়ি আবারও ‘সাদা সোনা’র মর্যাদা ফিরে পাবে এবং বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাজারে আরও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পারবে।