শেয়ারবাজারে টানা দ্বিতীয় সপ্তাহেও সূচক ও লেনদেন কমেছে। সব সূচক, বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম এবং মোট লেনদেন কমে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়েছে।
প্রধান সূচকের পতন
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাপ্তাহিক পর্যালোচনা অনুযায়ী, ডিএসইএক্স সূচক পাঁচ কার্যদিবসে ৭৩ পয়েন্ট হারিয়ে সপ্তাহ শেষে ৫,৪৪৯ পয়েন্টে নেমে আসে। সপ্তাহের শুরুতে এটি ছিল ৫,৫২৩ পয়েন্ট।
শরিয়াহভিত্তিক ডিএসইএস সূচক ১৮ পয়েন্ট এবং ব্লু-চিপ ডিএস৩০ সূচক ৪৩ পয়েন্ট কমে গেছে। সাপ্তাহিক হিসেবে ডিএসইএস ১.৫ শতাংশের বেশি এবং ডিএস৩০ সূচক ২ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে।
আগের বছরের তুলনায় কিছুটা এগিয়ে
যদিও সপ্তাহভিত্তিক পরিস্থিতি খারাপ, তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বাজার কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে। বছরওয়ারি হিসেবে ডিএসইএক্স সূচক ৪ শতাংশের বেশি এবং ডিএস৩০ সূচক ৮ শতাংশের বেশি বেড়েছে। তবে ডিএসইএস-এ উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন হয়নি।
লেনদেনে বড় ধস
বিনিয়োগকারীদের হতাশা স্পষ্ট হয়েছে দৈনিক লেনদেনের পতনে। যেখানে দৈনিক গড় লেনদেন এক সময় ১,০০০ কোটি টাকার ওপরে থাকত, সেখানে গত সপ্তাহে তা নেমে এসেছে ৭০০ কোটিতে। এক সপ্তাহে শেয়ার ও ইউনিট লেনদেনের পরিমাণ ৩৯ শতাংশ কমেছে।
এক দশকের অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী তারিকুল ইসলাম বলেন, “বাজারে ওঠানামা স্বাভাবিক। কিন্তু যখন ১,০০০ কোটি টাকার লেনদেন হঠাৎ ৭০০ কোটিতে নেমে যায়, তখন উদ্বেগের কারণ তৈরি হয়। ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়া এবং খারাপ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে অস্বাভাবিক লেনদেন বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দেয়।”
অন্য এক বিনিয়োগকারী সাজেদা আক্তার বলেন, “গত এক বছরে কমিশন নানা সংস্কারের কাজ করেছে। কিন্তু বাজার পড়লেই দুর্বল কোম্পানিগুলো প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। অনেক উৎপাদনহীন কোম্পানির শেয়ারের দাম ভেতরের লেনদেনে বেড়ে যায়।”
সংস্কার ও নতুন আইনের দাবি
অনেক বিনিয়োগকারী অকার্যকর কোম্পানিগুলোকে বাদ দিতে বাই-ব্যাক আইন প্রণয়নের দাবি তুলেছেন। বিনিয়োগকারী রুহুল আমিন বলেন, “কিছু শেল কোম্পানি বাজারকে নিচে টেনে ধরছে। এগুলো তালিকাভুক্ত হওয়াই উচিত ছিল না। বাই-ব্যাক আইন চালু হলে এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে বাদ দেওয়া সম্ভব হবে।”
খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ
২১ খাতের মধ্যে ২০ খাতেই শেয়ারের দাম কমেছে। শুধুমাত্র আবাসন খাত সামান্য বেড়েছে।
প্রধান খাতগুলোর মধ্যে ব্যাংক খাত ১৭ শতাংশের বেশি, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৫৪ শতাংশ, সাধারণ বীমা ৭০ শতাংশ এবং জীবন বীমা ৫৭ শতাংশ কমেছে।
জ্বালানি খাত ৫৭ শতাংশের বেশি, টেলিযোগাযোগ ৫৯ শতাংশ এবং ওষুধ খাত ২২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
কোম্পানি লেনদেনের চিত্র
সপ্তাহে ডিএসইতে লেনদেন হওয়া কোম্পানির মধ্যে ৬৮টির দাম বেড়েছে, ৩০৬টির কমেছে এবং ২৩টির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ব্রোকারেজ হাউসগুলো মনে করে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাম্প্রতিক জরিমানা ও বিধিনিষেধ বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তারা মনে করে, হঠাৎ বড় জরিমানা বা নিষেধাজ্ঞা দিলে বাজার নেমে যায়।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
মতিঝিলে একটি ব্রোকারেজ শাখার কর্মকর্তা বলেন, “কমিশন হঠাৎ বড় পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু তখনই বাজার পড়ে যায়। শেয়ারবাজার ভঙ্গুর, তাই সংস্কার ধাপে ধাপে করতে হবে।”
একইভাবে পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের এক সদস্য বলেন, “আমরা সবসময় কমিশনকে বলেছি, হঠাৎ বড় পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। এতে বিনিয়োগকারীরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।”
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চিত্র
ঢাকার মতো চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সূচকও কমেছে। ক্যাসপি সূচক ১৮২ পয়েন্ট পড়ে গেছে। সিএসই-৩০ এবং সিএসই-৫০ সূচকও ১ শতাংশের বেশি কমেছে।
সিএসইতে মোট ৩১২ কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৮৯টির দাম বেড়েছে, ১৯৫টির কমেছে এবং ২৮টির দাম অপরিবর্তিত ছিল।
স্থিতিশীলতার জন্য করণীয়
বাজারসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ভালো কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করা এবং দুর্বল কোম্পানিগুলোকে বাদ দেওয়া না গেলে কোনো সংস্কারই বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে পারবে না।