বাংলাদেশের চামড়া শিল্প এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি সীমা অতিক্রম করতে হিমশিম খাচ্ছে। খাতটির নেতারা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অনুপালন ঘাটতি এবং নতুন বিনিয়োগের অভাব এ ক্ষেত্রে প্রধান বাধা।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা একে বর্ণনা করেছেন ‘বিলিয়ন-ডলারের খাঁচায় বন্দি খাত’ হিসেবে। তাদের মতে, বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের ২০৩০ সালের মধ্যে অনুমিত ৫ বিলিয়ন ডলারের সম্ভাবনা অর্জনে বড় অন্তরায়।
অবকাঠামো ও পরিবেশগত অনুপালন সংকট
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড না মানা এবং প্রধান অংশীদারদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবই বড় বাধা।
সাভার ট্যানারি এস্টেট, যা খাতটির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এর কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না এবং অপরিশোধিত পানি পরিবেশে ছাড়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, পরিবেশগত অনুপালন না থাকার কারণে স্থানীয় ট্যানারিগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজ) সার্টিফিকেশন পায় না।
সরকারের অগ্রাধিকার খাত হলেও অচলাবস্থা
সব সরকারই চামড়া খাতকে সম্ভাবনাময় হিসেবে অগ্রাধিকার দিয়েছে, কারণ এতে প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে টেক্সটাইল ও পোশাকের পর চামড়া ও জুতাশিল্পই বৃহত্তম রপ্তানিমুখী উৎপাদন খাত।
শাহীন আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক মান, সামাজিক ও পরিবেশগত অনুশাসন বজায় রাখা আমাদের দায়িত্ব। এতে বাংলাদেশকে সমাপ্ত চামড়ার শীর্ষ সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে।”
তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প বহুদিন ধরে দূষণের সঙ্গে জড়িত। অনেক অনিয়ন্ত্রিত ট্যানারি অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলে নদী দূষণ করছে। কঠিন বর্জ্য ফেলা, পানির অদক্ষ ব্যবহার ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করছে।
এলডব্লিউজ সার্টিফিকেশনের ঘাটতি
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, এলডব্লিউজ সার্টিফিকেশন না থাকাই সবচেয়ে বড় বাধা। এর ফলে বাংলাদেশ প্রিমিয়াম বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না এবং কাঁচা চামড়া ২০-৩০ শতাংশ কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। তুলনায়, ভারতে ১৫০টির বেশি এবং পাকিস্তানে ৮০টিরও বেশি এলডব্লিউজ-সার্টিফাইড ট্যানারি রয়েছে, অথচ বাংলাদেশে একটি নেই।
তিনি জানান, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় কাঁচা চামড়া উৎপাদনকারী বাংলাদেশ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি রপ্তানি আয়েই আটকে আছে।
ড. মাসরুর বলেন, “বিশ্বের অন্যতম বড় কাঁচা চামড়ার সরবরাহ, বিপুল শ্রমশক্তি এবং সরকারের রপ্তানি প্রণোদনা থাকলেও অবকাঠামো, মানদণ্ডের অনুপালন, সমন্বয় ও বিনিয়োগ বিশ্বমান থেকে অনেক পিছিয়ে।”
ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সার্টিফিকেশন ও মানদণ্ড পূরণ না হওয়ায় বাংলাদেশের চামড়া এড়িয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশ বেশি দামে বিক্রি সম্ভব সমাপ্ত চামড়াজাত পণ্যের পরিবর্তে তুলনামূলক কম দামের সেমি-প্রসেসড ‘ওয়েট ব্লু’ রপ্তানিতে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলো প্রায়ই ঋণ অনুমোদনের আগে এলডব্লিউজ সার্টিফিকেশন বা পরিবেশবান্ধব প্রমাণপত্র চায়। এতে দেশীয় উৎপাদকরা উচ্চমূল্যের আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পারছে না।
খাতের অভ্যন্তরীণ সংকট
খাতটিতে বিভক্ত ইকোসিস্টেম, কাঁচা চামড়ার মান নির্ধারণ বা কেন্দ্রীয় নিলাম প্রক্রিয়া না থাকা, ট্যানারিদের নগদ অর্থ সংকট, অপ্রয়োজনীয় মধ্যস্বত্বভোগী, সীমিত উল্লম্ব সংহতি, নিজস্বভাবে ব্যাগ বা জুতা তৈরি না করার প্রবণতাকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
অন্যদিকে, অনেক ব্র্যান্ড অসঙ্গতিপূর্ণ ও অননুমোদিত উৎস থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে। ধীর প্রযুক্তি গ্রহণ, পুরনো যন্ত্রপাতি ও ফিনিশিং পদ্ধতি, পরিবেশগত অনুপালনের ব্যর্থতা ও অদক্ষ মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
কোরবানির ঈদে চামড়া সংরক্ষণ ও পরিবহনে ত্রুটির কারণে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত অপচয় হয়। প্রযুক্তি ও সমন্বয়ের ঘাটতি এই সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
শ্রমিক অধিকারের সংকট
ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্প ৭০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী খাত। তবে শ্রমিকদের অনেকেই এখনো নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র কিংবা ন্যূনতম মজুরির মতো মৌলিক শ্রম অধিকার পান না।
তিনি বলেন, “মালিকরা শ্রমিকদের অধিকার দিতে অনিচ্ছুক, অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য এসব অনুপালন অপরিহার্য।”
তিনি আরও জানান, সামাজিক অনুপালনের অভাব ও সিইটিপির আধুনিকীকরণের ব্যর্থতার কারণে এলডব্লিউজ সার্টিফিকেশন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বিদেশি ক্রেতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং আনুষ্ঠানিক খাত ক্রমে অনানুষ্ঠানিক হয়ে যাচ্ছে।
সম্ভাবনা উন্মোচনে প্রস্তাবনা
বিশেষজ্ঞরা খাতটির সম্ভাবনা উন্মোচনে কিছু পদক্ষেপ প্রস্তাব করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে দ্রুত সাভার ট্যানারি এস্টেট ও সিইটিপি সম্পন্ন ও আধুনিকীকরণ, এলডব্লিউজ সার্টিফিকেশনকে জাতীয় অগ্রাধিকারে আনা, এ জন্য কর রেয়াত বা সহজ ঋণ দেওয়া, এবং মৌসুমভিত্তিক মূল্য পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
এছাড়া কাঁচা চামড়ার পরিবর্তে সমাপ্ত চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগগুলোকে ডিজাইন ও ব্র্যান্ডিং সহায়তা প্রদান, এবং কাঠামোগত সংস্কারকে শিল্পের অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।