গ্রিসের গ্যালাক্সিডিতে একটি মাছের খামার।
জলজ খাদ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়তে থাকায় বিশ্বের প্রাকৃতিক মাছের মজুত সীমার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। চাহিদা মেটাতে এগিয়ে আসছে চাষকৃত মাছ, তবে এর ফলে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র মারাত্মক চাপের মধ্যে পড়ছে।
সুখবর হলো, গত ছয় দশক ধরে মাছসহ অন্যান্য জলজ খাদ্য জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি অবদান রাখছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ইউএনএফএও) জানিয়েছে, ১৯৬১ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী জলজ খাদ্যের (শৈবাল বাদে) ভোগ গড়ে প্রতি বছর তিন শতাংশ হারে বেড়েছে—যা বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের প্রায় দ্বিগুণ। ইউএনএফএওর হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মাথাপিছু জলজ খাদ্য ভোগ আরও ১৫ শতাংশ বাড়বে এবং বছরে গড়ে ২১.৪ কিলোগ্রামে পৌঁছাবে।
প্রাকৃতিক মজুত স্থির, বাড়ছে মাছের চাষ
২০২০ সালে জলজ প্রাণীর মোট উৎপাদন ২০০০ সালের তুলনায় ৩০ শতাংশ এবং ১৯৯০ সালের তুলনায় ৬০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। তবে এই বৃদ্ধির উৎস প্রাকৃতিক মাছ ধরা নয়। ১৯৯০ সাল থেকে প্রাকৃতিকভাবে ধরা মাছের পরিমাণ প্রায় ৯ কোটি টনের আশপাশে স্থির রয়েছে। গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচের প্রধান নির্বাহী টনি লং বলেন, ‘প্রাকৃতিক মাছের মজুত সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে। বৈশ্বিক মাছ ধরার শিল্প বিশ্বকে খাদ্য সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তবে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে এটি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠতে পারে। অনটেকসই মাছ ধরার পদ্ধতি মাছের জনসংখ্যা হ্রাস করতে পারে, নাজুক সামুদ্রিক আবাসস্থল ধ্বংস করতে পারে এবং সমুদ্রের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।’
১৯৭৪ সালে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মাছের মজুত ছিল জৈবিকভাবে টেকসই পর্যায়ে। ২০২১ সালের মধ্যে এই হার নেমে দাঁড়িয়েছে ৬২.৩ শতাংশে এবং অনটেকসইভাবে ধরা মাছের হার প্রায় চারগুণ বেড়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (ডব্লিউডব্লিউএফ) ইন্টারন্যাশনালের রবিন ডেভিস বলেন, ‘বর্তমান পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক মাছ ধরা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়।’ এই শূন্যতা পূরণ করছে চাষকৃত মাছ। ১৯৯০ এর দশকে বিশ্বব্যাপী মাছের চাষ ছিল ১১ কোটি ১০ লাখ টন, যা ২০২২ সালে বেড়ে ১৮ কোটি ৫০ লাখ টনে পৌঁছেছে।
মাথাপিছু ভোগে আঞ্চলিক বৈষম্য
আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় মাথাপিছু মাছ ভোগ গড়ে বছরে ১০ কিলোগ্রামের মতো, আর এশিয়ায় তা ২৫ কিলোগ্রামের কাছাকাছি। চীন এককভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাছ ভোক্তা দেশ, ২০২১ সালে প্রায় ৬ কোটি টন মাছ খেয়েছে—যা বৈশ্বিক ভোগের ৩৬ শতাংশের বেশি। অন্যান্য বড় ভোক্তা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও বাংলাদেশ। বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশ মিলিয়ে বৈশ্বিক জলজ খাদ্য ভোগের ৭০ শতাংশের হিস্যা দখল করে। এশিয়াতেই ৮৪ শতাংশ জেলে ও মাছ চাষি রয়েছে এবং এশিয়ার দেশগুলো পরিচালনা করে ২৬ লাখ ৮০ হাজার মাছ ধরার নৌকা, যা বিশ্বব্যাপী বহরের দুই-তৃতীয়াংশ। বিশ্বব্যাপী মৎস্যশিল্পে কর্মরতদের প্রায় ২১ শতাংশ নারী।
অতিমাত্রায় মাছ ধরা ও অন্যান্য হুমকি
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহকারী মহাপরিচালক ম্যানুয়েল বারাঞ্জে বলেন, ‘আজকের জলজ খাদ্য ব্যবস্থার সামনে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, সমুদ্রের অম্লতা বৃদ্ধি এবং স্বাদুপানির প্রবাহের পরিবর্তন প্রজাতির বিস্তার পরিবর্তন করছে, আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে। এই জলবায়ুজনিত চাপের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূমি ও সমুদ্রের ব্যবহার পরিবর্তন, বর্জ্যপানি নির্গমন, কৃষির রাসায়নিক প্রবাহ এবং স্থল ও জলভিত্তিক দূষণ। এসব কারণে বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছে এবং মৎস্যসম্পদের দীর্ঘমেয়াদি টেকসইতা হুমকির মুখে পড়ছে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘মাছ ধরা আসলে একটি উত্তোলনমূলক কার্যক্রম—এটি পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’
সমুদ্র সম্পদের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা ও বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে জাতিসংঘ। এ লক্ষ্য পূরণে তারা ‘ব্লু ট্রান্সফরমেশন’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, যার উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য হলো বিশ্বের সব মৎস্য খাতকে কার্যকর ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা। বারাঞ্জে বলেন, ‘প্রায়ই সমুদ্র টেকসইতা নিয়ে আলোচনা হয় যেন এটি মানুষকে খাওয়ানো আর সমুদ্র রক্ষা করার মধ্যে একটির মধ্যে বেছে নেওয়ার প্রশ্ন। কিন্তু বিশ্বের ৭০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত এবং প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যকর খাদ্য কিনতে অক্ষম। তাই টেকসই জলজ খাদ্য ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি।’
বৈশ্বিক সুরক্ষা প্রচেষ্টা
এই বছর ফ্রান্সের নিস শহরে অনুষ্ঠিত এক বড় সম্মেলনে সমুদ্রের অতিরিক্ত মাছ ধরা এলাকা রক্ষায় বেশি সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রায় ২০০টি দেশ এতে অংশ নেয়, যদিও যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি। মূল লক্ষ্য ছিল ‘হাই সিস ট্রিটি’ অনুমোদন করা, যার মাধ্যমে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে যাতে সমুদ্রের ৩০ শতাংশ অঞ্চল সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং দেশগুলোকে অন্তত ৭২ বিলিয়ন ডলার তহবিলে অবদান রাখতে বাধ্য করা যায়। সম্মেলনের শেষে ৫১টি দেশ চুক্তি অনুমোদন করে। চুক্তি কার্যকর করতে মোট ৬০টি দেশের অনুমোদন প্রয়োজন, যা বছরের শেষে পূরণ হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
বারাঞ্জে বলেন, ‘অতিরিক্ত মাছ ধরা একটি গুরুতর কিন্তু অসম চ্যালেঞ্জ। মাছ ধরার পরিবেশগত প্রভাব স্থানীয় প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে—যেমন ব্যবহৃত সরঞ্জাম, আবাসস্থলের সংবেদনশীলতা এবং শাসনব্যবস্থার শক্তি।’
উত্তর-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে ৯৩ শতাংশ মাছের মজুত টেকসইভাবে ব্যবস্থাপিত হলেও ভূমধ্যসাগর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত মাছ ধরা সমুদ্র। আফ্রিকার উপকূলীয় জলসীমা এবং এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের বাইরে থাকা গভীর সমুদ্র বিদেশি বহরের তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছে। পূর্ব-মধ্য আটলান্টিকে মাত্র ৪৭ শতাংশ মাছের মজুত টেকসইভাবে ধরা হচ্ছে। নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে ক্ষুদ্র ও ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরা খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সীমিত প্রশাসনিক ক্ষমতা, দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং বড় ডেটা ঘাটতির কারণে এসব এলাকা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
গভীর সমুদ্রের প্রজাতির ঝুঁকি
টুনা মাছ ধরার সময় প্রায়ই হাঙর ও অন্যান্য গভীর সমুদ্রের প্রজাতি অনিচ্ছাকৃতভাবে জালে ধরা পড়ে। ডেভিসের মতে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১ লাখ হাঙর ও রে মাছ, ৭ লাখ ২০ হাজার সামুদ্রিক পাখি, ৩ লাখ ৪৫ হাজার সীল, ৩ লাখ তিমি ও ডলফিন এবং ২ লাখ ৫০ হাজার সামুদ্রিক কচ্ছপ অনিচ্ছাকৃতভাবে ধরা পড়ে। এদের অনেক প্রজাতি বিপন্ন বা সুরক্ষিত। কিছু প্রজাতি যেমন ভাকুইটা, পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের লেদারব্যাক কচ্ছপ এবং মাউই ডলফিন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
ট্রলার ও অ-নির্বাচিত মাছ ধরার পদ্ধতির হুমকি
তলদেশ ঘেঁষে মাছ ধরা বা ‘বটম ট্রলিং’ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়। মাছ ধরার শিল্প এটিকে কার্যকর বলে দাবি করলেও পরিবেশবাদীরা এটিকে ধ্বংসাত্মক বলে আখ্যা দেয়। টনি লং বলেন, ‘বটম ট্রলিং, ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘশৃঙ্খল লাইন ফেলা এবং ভাসমান জাল—এসব পদ্ধতি বাছবিচারহীন। এগুলো শুধু সমুদ্রতলের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে না, বরং তলদেশের অবক্ষেপও নাড়িয়ে দেয়, যা কার্বন সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন আরও দ্রুত হতে পারে।’
বিশ্বব্যাপী মোট মাছ ধরার ৪০ শতাংশ বটম ট্রলিংয়ের মাধ্যমে হয় এবং সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে এটি সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। ডেভিস বলেন, ‘বিশ্বে ৪০ লাখ মাছ ধরার নৌকা রয়েছে এবং অনেক নৌকাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে যা মাছ খুঁজে বের করা এবং ধরাকে সহজ করে তুলেছে। সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও আইন প্রয়োগের অভাবে কিছু মাছের মজুত সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে এবং কিছু প্রজাতি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।’
সার ডেভিড অ্যাটেনবারো উপস্থাপিত ‘ওশানস’ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে কীভাবে ভারী, দাঁতওয়ালা ধাতব ট্রল সমুদ্রের তলদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। নিস সম্মেলনের আগে সার ডেভিড বলেন, তিনি কিছু মাছ ধরার পদ্ধতির ক্ষয়ক্ষতি দেখে হতবাক এবং আশা করেন বিশ্বনেতারা বুঝতে পারবেন সমুদ্র আমাদের সবার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।