বিশ্বব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে কৃষি সম্প্রসারণ সেবার গুরুত্ব স্বীকার করেছে—যার মধ্যে প্রশিক্ষণ, তথ্য ও প্রযুক্তি হস্তান্তর অন্তর্ভুক্ত। কৃষি খাতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগ ক্ষেত্র এটি। কিন্তু কৃষকেরা প্রায়ই এসব সেবা গ্রহণে ধীরগতি দেখান—ফলে নিজেদের উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সীমিত হয়ে থাকে।
এর বড় কারণ হলো সীমিত সংখ্যক সম্প্রসারণ কর্মীর উপরে নির্ভরশীলতা। অধিকাংশ দেশে ১ হাজার থেকে ২ হাজার কৃষকের জন্য মাত্র একজন করে সম্প্রসারণ কর্মী থাকেন।
ডিজিটাল কৃষির সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা
ডিজিটাল কৃষি দীর্ঘদিন ধরে এই শূন্যতা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, বাজারদর, মোবাইল পেমেন্ট এবং কৃষিবিষয়ক পরামর্শ একত্রিত করে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। তবুও গত এক দশকে মোবাইল ফোন ও অন্যান্য প্রযুক্তিতে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সত্ত্বেও এর গ্রহণযোগ্যতা এখনো সীমিত। যেমন সাহারা-অবস্থানীয় আফ্রিকার বহু দেশে ১০ শতাংশেরও কম কৃষক এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। যদিও কিছু উদ্যোগ সফল হয়েছে—যেমন ভারতের ওডিশা সরকার চালু করা একটি ডিজিটাল কৃষি পরামর্শ সেবা, যা ৭০ লাখ কৃষকের কাছে পৌঁছেছে। কিন্তু ভাষা ও ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতি, কন্টেন্টের প্রাসঙ্গিকতা, খরচ এবং আস্থার সংকট এখনো প্রধান বাধা।
এআই ভিত্তিক পরামর্শ বিপ্লব
জেনারেটিভ এআই এই বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে। প্রাথমিক কিছু উদ্যোগের ফল ইতিমধ্যেই আশাব্যঞ্জক।
- ডিজিটাল গ্রীন নামের একটি প্রযুক্তি-নির্ভর অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এআই চালিত চ্যাটবট তৈরি করেছে, যা ৫টি দেশের ৪ লাখ ৬০ হাজার কৃষক ও সম্প্রসারণ কর্মীর কাছে পৌঁছেছে। এটি ৬টি ভাষায় ৪০টি ফসলের জন্য সহায়তা দিচ্ছে।
- ইনোভেটিভ সলিউশনস ফর ডিসিশন অ্যাগ্রিকালচার (iSDA) তৈরি করেছে ভার্চুয়াল এগ্রোনমিস্ট নামে একটি টুল, যা আফ্রিকার ৭টি দেশে ৩ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি জমিতে ব্যবহার হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপে এর মাধ্যমে কৃষকদের লাভ ৪.৭ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, ফলন ১.৬ গুণ বৃদ্ধি করেছে এবং ব্যবহারকারীর অংশগ্রহণ ৬০ শতাংশেরও বেশি।
- ভারতের সরকার চালু করেছে কিষাণ ই-মিত্র এআই চ্যাটবট, যা ভয়েস-ভিত্তিক এবং স্থানীয় ভাষায় কৃষকদের প্রশ্নের উত্তর দেয়। এখন পর্যন্ত এটি সরাসরি ভর্তুকি ও কল্যাণ কর্মসূচি সংক্রান্ত ৮২ লাখ প্রশ্নের সমাধান করেছে।
কীভাবে এআই পরামর্শ কার্যকর হয়?
জেনারেটিভ এআই সরাসরি ডিজিটাল সাক্ষরতা, ভাষাগত সীমাবদ্ধতা এবং তথ্যের প্রাসঙ্গিকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে। কৃষকেরা তাদের দৈনন্দিন ভাষায় ভয়েস-ভিত্তিক ইন্টারফেসের মাধ্যমে পরামর্শ পান। এটি তাদের বিভিন্ন বিকল্প বিবেচনা করতে সহায়তা করে, ছবি চিনে ফসলের রোগ নির্ণয় করে এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রাসঙ্গিক পরামর্শ দেয়।
এআই ও মানুষের মিশ্র সেবা কার্যকারিতা বাড়ায় এবং খরচ কমায়। আগে যেখানে প্রতি কৃষকের জন্য বছরে প্রায় ৫ ডলার খরচ হতো, এখন তা নেমে এসেছে ১ ডলারের নিচে। এআই প্রযুক্তির খরচ ১৮ মাসে প্রায় ২৪০ গুণ কমে আসায় আজ সেবা প্রদানের ব্যয় দাঁড়িয়েছে কৃষকপ্রতি বছরে প্রায় ১.৫ ডলার।
এই সাশ্রয় কৃষি সম্প্রসারণকে ব্যাপক মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে। যেমন কেনিয়ার ডিজিটাল জলবায়ু পরামর্শ এখন ৪৮ লাখ কৃষককে সেবা দিচ্ছে, যা দেশের মোট কৃষকের ৬২ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে এ হার ৯১ শতাংশে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ধরনের সিস্টেম কৃষকের প্রশ্ন ও সমস্যার তথ্য সংগ্রহ করে বাজার ও গবেষণার জন্য নতুন চাহিদা-ভিত্তিক তথ্য তৈরি করছে, যা নীতি নির্ধারক, সরবরাহকারী ও গবেষক সবাইকে উপকৃত করছে।
ঝুঁকিপূর্ণ “হ্যালুসিনেশন”
তবে ঝুঁকিও রয়েছে। জেনারেটিভ এআই মডেল প্রোবাবিলিস্টিক পদ্ধতিতে কাজ করে—ফলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভুল তথ্যও দিতে পারে, যাকে “হ্যালুসিনেশন” বলা হয়। কৃষিতে যেমন কীটনাশক ব্যবহারের ভুল পরামর্শ বা সার প্রয়োগের ভুল সময় নির্ধারণ গুরুতর ক্ষতি, আইন লঙ্ঘন বা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এতে প্রযুক্তির উপর আস্থাও নষ্ট হতে পারে।
এই ঝুঁকি কমাতে অধিকাংশ সেবায় “হিউম্যান-ইন-দ্য-লুপ” মডেল ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে বিশেষজ্ঞরা এআই-এর ফলাফল যাচাই করে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেন।
ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজন বহুস্তরীয় তদারকি—যেমন অ্যাপভিত্তিক রেটিং সিস্টেম, দুর্বলতা চিহ্নিত করতে কঠোর পরীক্ষণ (“রেড টিমিং”), এবং আইন, বিপণন ও প্রযুক্তি-টিমের মাধ্যমে সুশাসন কাঠামো। এছাড়া বিভিন্ন এআই টুল ও চ্যাটবটের তুলনা করার জন্য মানদণ্ড তৈরি করাও জরুরি।
বৃহৎ পরিসরে প্রয়োগ ও ভবিষ্যৎ পথ
এআই-ভিত্তিক কৃষি পরামর্শকে বৃহৎ পরিসরে কার্যকর করতে হবে ডিজিটাল অবকাঠামো, ডেটা সেবা, অঞ্চলভিত্তিক এআই টুল এবং সহজলভ্য যোগাযোগ চ্যানেলের মাধ্যমে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃষকের আস্থা অর্জন।
কৃষক ও তাদের সম্পদ সংক্রান্ত তথ্য যত বাড়বে, নতুন মডেল তৈরি ও প্রয়োগের খরচ তত বাড়বে, তবে এর সুফলও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া সফল প্রয়োগের জন্য দরকার বহুপাক্ষিক সহযোগিতা—যেখানে বিশ্বব্যাপী এআই প্রদানকারী, কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, এগ্রি-টেক উদ্ভাবক এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এক সঙ্গে কাজ করবে।
জেনারেটিভ এআই কৃষি সম্প্রসারণের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ছোট কৃষকদের নির্দিষ্ট ও সময়োপযোগী পরামর্শ দিতে পারে—তাদের সাক্ষরতা, ভাষা বা অবস্থান যাই হোক না কেন। বিশ্বব্যাংক ও গেটস ফাউন্ডেশন এ নিয়ে একত্রে কাজ করছে।