চীনের শ্রমবাজারে এক অভূতপূর্ব রূপান্তর ঘটছে। কৃষিভিত্তিক ও শিল্পশ্রমিকদের পাশাপাশি জন্ম নিয়েছে নতুন এক শ্রেণি—গিগ কর্মী। ক্ষণস্থায়ী কাজ খুঁজে পাওয়া এই প্ল্যাটফর্ম-নির্ভর শ্রমশক্তি এখন শহরের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ। তাদের সংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। স্থায়ী চাকরির নিশ্চয়তা না থাকলেও গিগ কর্মীরা চীনের অর্থনীতি ও সমাজকে আগামী বহু বছর প্রভাবিত করবে।
বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত গিগ অর্থনীতি
গিগ অর্থনীতির বিস্তারে চীনের অভিজ্ঞতা বিশ্বের অন্য অনেক দেশের চেয়ে ভিন্ন। এর মূল কারণ ‘সুপারঅ্যাপ’। এই ধরনের অ্যাপ একসঙ্গে পরিবহন, পেমেন্ট, খাবার সরবরাহ থেকে শুরু করে নানা কাজের সুযোগ তৈরি করেছে। বর্তমানে প্রায় ৮ কোটি ৪০ লাখ চীনা নাগরিক রাইড-শেয়ার ড্রাইভার বা খাবার সরবরাহকারী হিসেবে সরাসরি যুক্ত।
শুধু চীনেই নয়, ভারত ও মালয়েশিয়ার মতো উদীয়মান এশীয় দেশেও এই ধারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতে প্রায় এক কোটি মানুষ এবং মালয়েশিয়ায় ১২ লাখ মানুষ এখন গিগ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত।
কারখানায় গিগ কর্মীর উত্থান
শিল্পখাতেও একই রূপান্তর ঘটছে। নিয়মিত শিল্পশ্রমিকদের জায়গায় এসেছে অস্থায়ী কর্মীবাহিনী। বড় বড় প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ‘অন ডিমান্ড’ কাজ এখন শিল্প উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি দখল করেছে। গবেষণা বলছে, এই ধরনের কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি—যা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় তিনগুণেরও বেশি।
কেন বাড়ছে গিগ কাজ?
প্রধান কারণ হলো নমনীয়তা। কোম্পানিগুলো মৌসুমি চাহিদা, বাজারের ওঠানামা কিংবা ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে তাল মেলাতে শ্রমশক্তি বাড়ানো-কমানোর সুযোগ চায়। স্মার্টফোন অ্যাপ সহজে গ্রাহক ও কর্মীকে মিলিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি অটোমেশিন অনেক জটিল কাজকে সরল করেছে, যেখানে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন নেই। ফলে গিগ কাজ অনেকের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠছে।
সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা
গিগ অর্থনীতি অনেকের জন্য বাড়তি আয়ের উৎস। জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালে চীনের খাবার সরবরাহকারীদের গড় মাসিক আয় অভিবাসী শ্রমিকদের তুলনায় এক-পঞ্চমাংশ বেশি। তরুণ প্রজন্মও একঘেয়ে কারখানার চাকরির চেয়ে এ ধরনের কাজে আগ্রহী হচ্ছে।
তবে সীমাবদ্ধতাও কম নয়। স্থায়ী নিয়োগ না থাকায় দীর্ঘমেয়াদি দক্ষতা অর্জন করা কঠিন। প্রমাণসাপেক্ষ চাকরি না থাকায় সরকারি সেবা পাওয়াও সীমিত হয়ে পড়ে। শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস গড়ে তোলার সুযোগ কমে যায়। এর প্রভাব সামাজিক ক্ষেত্রেও পড়ছে—বিয়ে ও সন্তান জন্মদানে অনীহা বাড়লে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সংকট আরও গভীর হতে পারে।
চীনের বাইরে শিক্ষা
‘হুকৌ’ নামের আবাসন-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চীনের জন্য বিশেষ হলেও সার্বিক অভিজ্ঞতা এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি সবসময় স্থায়ী সমাধান দেয় না, কারণ অটোমেশন চাকরির সংখ্যা কমাচ্ছে। জরিপ বলছে, চীনের ৭৭ শতাংশ রাইড-শেয়ার ড্রাইভার আগের চাকরি হারানোর পর এই খাতে এসেছেন। অর্থাৎ বিকল্প কাজ না থাকলে গিগ কাজই হয়ে উঠছে আশ্রয়স্থল।
রাষ্ট্রের ভূমিকা
সরকারকে নতুন সামাজিক চুক্তি তৈরি করতে হচ্ছে। চীন ইতোমধ্যেই অ্যালগরিদমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোকে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে উৎসাহিত করছে। ভারতও প্ল্যাটফর্ম কর্মীদের নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে তারা দুর্ঘটনা বিমা ও স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পান। ভবিষ্যতে পেনশন ব্যবস্থা আরও নমনীয় করা এবং নিয়োগদাতাদের বাধ্যতামূলক অবদান কমানোর দিকেও জোর দেওয়া প্রয়োজন।
এশিয়ার বহু দেশ ধনী হওয়ার আগেই বৃদ্ধ হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে আছে। তাই গিগ কর্মীদের মতো অস্থায়ী শ্রমশক্তির উন্নয়ন নিশ্চিত করা জরুরি। চীনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে?