২২ সেপ্টেম্বর উত্তর গোলার্ধে শরৎ বিষুব দিবস পালিত হয়। এ দিন থেকে রাত দীর্ঘ হতে থাকে এবং দিনের দৈর্ঘ্য কমে আসে। শীতের সময় ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ সূর্যের উষ্ণ আলো পেতে ক্যারিবিয়ান বা উত্তর আফ্রিকার সৈকতের দিকে ছুটে যায়।
তবে চিকিৎসকরা চান না তারা এভাবে ভ্রমণে বের হোক। কারণ সূর্যের অতিবেগুনি (UV) রশ্মি ত্বককে দ্রুত বুড়ো করে ফেলে এবং ত্বকের কোষের ডিএনএ নষ্ট করে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। বিশ্বজুড়ে ত্বকের ক্যানসারের হার ক্রমেই বাড়ছে। ভিটামিন ডি তৈরির জন্য কিছু সূর্যালোক দরকার হলেও, এই ভিটামিন খাবার বা সাপ্লিমেন্ট থেকেও পাওয়া সম্ভব। তাই কয়েক দশক ধরে জনস্বাস্থ্য নির্দেশিকায় সূর্য এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—ছায়ায় থাকা, শরীর ঢেকে রাখা এবং সানস্ক্রিন ব্যবহার করার মাধ্যমে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, উত্তর ইউরোপের মতো কম সূর্যালোকপ্রাপ্ত অঞ্চলে এ পরামর্শ হয়তো কিছুটা অতিরিক্ত হয়ে গেছে। নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ভিটামিন ডি ছাড়াও সূর্যের আলো মানবদেহে নানা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যেমন হৃদরোগ, ক্যানসার ও অটোইমিউন রোগ থেকে সুরক্ষা।
গবেষণার ফলাফল
গত বছর ব্রিটেনের ৩ লাখ ৬০ হাজার শ্বেতাঙ্গ মানুষের স্বাস্থ্য তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। এতে দেখা যায়, যারা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাস করে বা নিয়মিত সানবেড ব্যবহার করে, তাদের মৃত্যুঝুঁকি যথাক্রমে ১২% এবং ১৫% কম।
এ ফলাফল সুইডেনের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণার সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে ৩০ হাজার সুইডিশ নারীকে ২০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়। দেখা যায়, সূর্যের আলোতে বেশি সময় কাটানো নারীদের মৃত্যুঝুঁকি অর্ধেক কম যারা সূর্যালোক এড়িয়ে চলেছে তাদের তুলনায়।
গবেষক রিচার্ড ওয়েলার বলেন,
“বৃহৎ পরিসরে দেখলে সূর্যালোকের উপকারিতা এর ঝুঁকির চেয়ে বেশি—যদি কেউ সানবার্নে আক্রান্ত না হয়।”
এ বছরের জুনে প্রকাশিত এক রিভিউ পেপারে ১৭ জন বিজ্ঞানী UV রশ্মির ইতিবাচক প্রভাবের প্রতি জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে আরও মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান।
বিবর্তন ও মানবদেহের অভিযোজন
মানবজাতির বিবর্তন সূর্যালোকের গুরুত্বকে প্রমাণ করে। আফ্রিকার প্রচণ্ড সূর্যের নিচে বসবাসকারী প্রাচীন মানুষের ত্বকে প্রচুর মেলানিন ছিল, যা UV রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করত। পরে কিছু মানুষ উত্তর দিকে কম সূর্যালোকপ্রাপ্ত অঞ্চলে চলে গেলে তাদের বংশধরদের ত্বকে মেলানিনের মাত্রা কমে যায়, যাতে বেশি UV রশ্মি শোষিত হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার গবেষক ডেভিড হুইটম্যান বলেন, শ্বেতাঙ্গ ত্বক অন্তত দুইবার আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছে—একবার ইউরোপীয়দের মধ্যে এবং আরেকবার পূর্ব এশীয়দের মধ্যে। এটি মানবজীবনে UV রশ্মির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রমাণ।
ভিটামিন ডি এবং অন্যান্য উপকারিতা
UV রশ্মির সবচেয়ে পরিচিত সুফল হলো ভিটামিন ডি উৎপাদন। ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি শিশুদের হাড় নরম হয়ে বিকৃতির কারণ হতে পারে। উচ্চ মাত্রার ভিটামিন ডি হৃদযন্ত্রের সুস্থতা এবং ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতেও সহায়ক।
তবে সাম্প্রতিক বড় গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্টের উল্লেখযোগ্য কোনো উপকারিতা নেই। ২০২২ সালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে সাধারণ মানুষের জন্য ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট সুপারিশ বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।
ফলে কিছু গবেষক মনে করছেন, ভিটামিন ডি নয় বরং সূর্যের আলো মানবদেহে অন্য রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করছে। এর মধ্যে একটি হলো নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন, যা রক্তনালী শিথিল করে রক্তচাপ কমায়। ২০০৯ সালে জার্মানির এক গবেষণায় দেখা যায়, UV আলো ত্বকের নির্দিষ্ট রাসায়নিককে নাইট্রিক অক্সাইডে রূপান্তরিত করে, যা রক্তে প্রবেশের পর দ্রুত রক্তচাপ কমিয়ে দেয়।
অক্ষাংশ, রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি
২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিষুবরেখা থেকে প্রতি হাজার কিলোমিটার উত্তরে গেলে রক্তচাপ গড়ে ৫ মিলিমিটার পারদ (mmHg) বাড়ে। আর উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
উচ্চ অক্ষাংশের দেশগুলোতে শীতকালে হৃদরোগে মৃত্যুহার বেশি এবং গ্রীষ্মে কম থাকে। যদিও এর একটি কারণ ঠান্ডা আবহাওয়া ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, বিজ্ঞানীরা মনে করেন সূর্যালোকের অভাবও একটি বড় ভূমিকা রাখে।
সূর্যের আলো ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
সূর্যের আলো ইমিউন সিস্টেমে সরাসরি প্রভাব ফেলে। উদাহরণ হিসেবে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (MS) রোগকে উল্লেখ করা যায়। এই রোগ উচ্চ অক্ষাংশের অঞ্চলে বেশি দেখা যায় এবং সূর্যের আলো এ রোগের লক্ষণ কিছুটা হ্রাস করতে পারে।
গবেষক আমায়া বিরোস এবং রিচার্ড ওয়েলার বর্তমানে এমন এক প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন যা ভিটামিন ডি-এর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, কিন্তু ক্যানসারের বিস্তার কমাতে সহায়ক হতে পারে।
এছাড়া সূর্যের আলো ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতেও সহায়তা করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, সূর্যালোকের ঘাটতির কারণে এশিয়ার কিছু শহরে ৮০% এর বেশি কিশোর-কিশোরীকে চশমা পরতে হয়।
জনস্বাস্থ্য নির্দেশনা নিয়ে নতুন ভাবনা
বিভিন্ন গবেষক জনস্বাস্থ্য নির্দেশিকায় পরিবর্তনের আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের মতে, ত্বকের রঙ এবং ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সূর্যের ঝুঁকি ও উপকারিতা ভিন্ন হতে পারে।
ব্রিটেনে প্রতি বছর হৃদরোগে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সেখানে ত্বকের ক্যানসারে মৃত্যু হয় মাত্র ৩ হাজার মানুষের। এ কারণে অনেকে মনে করেন সূর্যালোক এড়ানোর কড়া নির্দেশনা পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
তবে সবাই এ বিষয়ে একমত নন। অনেক গবেষণা মূলত শ্বেতাঙ্গ এবং সূর্যালোক কম পাওয়া অঞ্চলের মানুষের ওপর হয়েছে। ফলে ফলাফল নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
অস্ট্রেলিয়ার অভিজ্ঞতা
অস্ট্রেলিয়ায় শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় দেশটিতে ত্বকের ক্যানসারের হার বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। তাই সেখানে সূর্য এড়ানোর প্রচার অত্যন্ত জোরালো।
তবে গত বছর দেশটি তাদের নির্দেশিকা কিছুটা নরম করেছে। নতুন নীতিতে সূর্যালোকের সুফল এবং ত্বকের রঙের পার্থক্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
“কেউ বলছে না যে আপনাকে সানবার্নে আক্রান্ত হতে হবে। তবে এখন এমন কিছু সহকর্মী আছেন যারা আগে সূর্যের আলোতে বসতে নিষেধ করতেন, কিন্তু এখন হয়তো কিছুটা মন পরিবর্তন করছেন।”
সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সূর্যের আলো একেবারে এড়িয়ে চলা এবং অতিরিক্তভাবে গ্রহণ—দুটিই ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ব্যক্তির ত্বকের রঙ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় রেখে সূর্যালোকের সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।