ক্যাট স্টিভেন্স নামে বিশ্বখ্যাত গায়ক-গীতিকার থেকে ইউসুফ ইসলাম—এটি এক অদ্ভুত যাত্রা। একসময়কার বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী ইউসুফ ইসলাম (আগের নাম স্টিভেন জর্জিউ) ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে সংগীতজগৎ ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রায় ৩৫ বছর ধরে তিনি নিজের কাহিনি বলার প্রস্তুতি নিতে নিতে অবশেষে লিখেছেন তাঁর স্মৃতিকথা, “Cat on the Road to Findout”, যা প্রকাশিত হবে ২০২৫ সালের ৭ অক্টোবর। বইটিতে তাঁর জীবনের অজানা দিক, বিতর্কিত মুহূর্তগুলোর ব্যাখ্যা এবং আধ্যাত্মিক খোঁজের কাহিনি ফুটে উঠেছে।
শৈশব ও প্রথম জীবনের সংকট
ইউসুফ ইসলামের জীবনে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল তিনবার।
প্রথমবার, কিশোর বয়সে লন্ডনের ছাদে দৌড়াদৌড়ির সময় তিনি পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে বন্ধুর হাতে রক্ষা পান।
দ্বিতীয়বার, ২০ বছর বয়সে টিউবারকিউলোসিসে আক্রান্ত হয়ে রক্ত কাশতে শুরু করলে ডাক্তাররা তাঁর জীবন নিয়ে শঙ্কিত হন।
তৃতীয়বার, ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে মালিবু, ক্যালিফোর্নিয়ায় সাঁতার কাটতে গিয়ে সমুদ্রের স্রোতে ভেসে যান। তখন তিনি মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে প্রার্থনা করেন, “হে ঈশ্বর, যদি বাঁচিয়ে রাখো, আমি তোমার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করব।” এরপরই একটি ঢেউ তাঁকে তীরে ঠেলে দেয়।
এই অভিজ্ঞতা তাঁর আধ্যাত্মিক খোঁজকে ত্বরান্বিত করে। সেই সময় তিনি বৌদ্ধধর্মের বই “The Secret Path” পড়েন, জ্যোতিষশাস্ত্র ও যোগচর্চায় মন দেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর বড় ভাই ডেভিড জেরুজালেমের এক মসজিদ থেকে কোরআন এনে দেন, যা তাঁর জীবনের পথ পাল্টে দেয়।
ইসলাম গ্রহণ ও সংগীত থেকে বিদায়
১৯৭৭ সালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ১৯৭৮ সালে নাম পরিবর্তন করে রাখেন ইউসুফ ইসলাম। সেই বছরই তিনি শেষ অ্যালবাম “Back to Earth” প্রকাশ করে সংগীতজগত থেকে বিদায় নেন।
প্রথম তিন বছর তিনি সংগীত নিষিদ্ধ কি না, তা নিয়ে দ্বিধায় ভুগতে থাকেন। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি ধর্মীয় পুস্তিকা তাঁকে সংগীত বর্জনের দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৮১ সালে তিনি নিজের প্রায় সব সংগীতযন্ত্র ও স্মারক জিনিসপত্র নিলামে বিক্রি করে অর্থ দান করেন।
সংগীতে প্রত্যাবর্তন: ছেলের প্রেরণা
২০০২ সালে তাঁর ছেলে মুহাম্মদ একটি গিটার কিনে আনেন। একদিন ইউসুফ গিটারটি হাতে নিয়ে বাজানো শুরু করেন। পরদিনই তিনি একটি গান লিখে ফেলেন। এটি তাঁর সংগীতে ফেরার সূচনা।
ইউসুফ ইসলামের সংগীতে ফেরা ধীরে ধীরে শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে “The Life of the Last Prophet” অ্যালবাম দিয়ে, যেখানে কোরআনের পাঠ ও ইসলামী নাশিদ ছিল। পরে তিনি শিশুদের জন্য ইসলামী গানও রেকর্ড করেন। কিন্তু ছেলের গিটার তাঁর মনে নতুন সুরের জন্ম দেয়।
এরপর তিনি ডলি পার্টন, পল ম্যাককার্টনির মতো শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেন এবং “Tea for the Tillerman” সহ তাঁর পুরোনো অ্যালবামের বিশেষ সংস্করণ প্রকাশ করেন।
আধ্যাত্মিকতা ও সংগীতের সমন্বয়
প্রথম দিকে তিনি ভেবেছিলেন সংগীত ইসলামবিরোধী। কিন্তু পরে উপলব্ধি করেন, সংগীত নিয়েও ইসলামী দুনিয়ায় ভিন্নমত আছে। তাই তিনি নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করে সংগীতে ফিরে আসেন। ২০১৪ সালে তিনি “Why I Still Carry a Guitar” বই প্রকাশ করেন, যেখানে মুসলিম সমাজের কাছে নিজের সংগীতচর্চার যুক্তি তুলে ধরেন।
তিনি ইসলামের কোনো নির্দিষ্ট মাযহাব বা গোষ্ঠীর অনুসারী হননি। তাঁর মতে, “আমি কোনো সীমানা দেখি না। আমি ঐক্যের দিকে ফিরে যাই।”
বিতর্ক ও সমালোচনা
বইটিতে তিনি স্বীকার করেছেন যে, জীবনের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত তাঁর ছিল।
- সালমান রুশদির ফতোয়া ইস্যুতে মন্তব্য:১৯৮৯ সালে তাঁর অস্পষ্ট মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক হয়।
- হামাসের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ:১৯৮৮ সাল থেকে তাঁকে হামাসপন্থী বলে অভিযুক্ত করা হয়, যা ২০০৬ সাল পর্যন্ত মার্কিন ভিসা জটিলতা তৈরি করে।
- ২০০৪ সালের বহিষ্কার:তিনি দাবি করেন, এটি প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রত্যাখ্যানের ফল ছিল।
তবে তিনি অনেক সাফল্যের কথাও উল্লেখ করেছেন, যেমন যুক্তরাজ্যে ইসলামী স্কুলের জন্য সরকারি অর্থ সংগ্রহ এবং উপসাগরীয় যুদ্ধ রোধে “পিস ক্যাম্প” উদ্যোগ।
বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি ও গাজার প্রসঙ্গ
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি ইউসুফ ইসলামের কাছে এক বৈশ্বিক পরীক্ষা। তাঁর মতে, ইসরায়েলের হামলার স্মৃতি নতুন প্রজন্ম কখনো ভুলবে না।
তিনি সংগীতের মাধ্যমে শান্তির বার্তা ছড়াতে চান এবং মনে করেন, তাঁর সংগীত এখন তাঁর আধ্যাত্মিক যাত্রারই অংশ।
ইউসুফ ইসলাম এখনো নিজেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন—একজন তারকা থেকে এক আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানীর যাত্রা। তাঁর নতুন আত্মজীবনীতে তিনি নিজের ভুল, অনুশোচনা এবং সাফল্যের গল্প বলেছেন।
তাঁর কথায়,
“আমি উত্তর খুঁজছিলাম, এবং অনেক উত্তর সংগীতে লুকিয়ে ছিল। যখন আমি সেই সত্য খুঁজে পেলাম, তখন গান না লেখার সিদ্ধান্তে মানুষের বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এখন আমি সেই সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি।”
“Cat on the Road to Findout” শুধু একটি আত্মজীবনী নয়, বরং এটি একজন শিল্পীর আত্মিক অনুসন্ধানের ইতিহাস।