০৭:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
সৌদি আরবের চোখ ইসরায়েলের এফ-৩৫ সফলতা ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন পরিকল্পনা: ইউক্রেন যুদ্ধে সমাপ্তি আনার চেষ্টা নাইজেরিয়ান ফটোগ্রাফার জে.ডি. ওজেইকিরে-এর অদেখা ছবি প্রকাশ বড় জয়, অস্বস্তিকর মুহূর্ত আর আবেগ—২০২৫ ARIA Awards ছিল টালমাটাল কিন্তু জীবন্ত  কমছে মার্কিনদের ছুটির কেনাকাটা, চাপের মুখে খুচরা বিক্রেতারা  অতিরিক্ত ক্ষমতা ও প্রযুক্তি বদলে বড় ধাক্কার মুখে ভারতের সোলার মডিউল শিল্প  জাপানের PAC-3 ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি, নিরাপত্তা নীতিতে নতুন ধাপ পুলিশের মনোবল ভাঙলে আবার নিজেকে নিজেই পাহারা দিতে হবে: ডিএমপি কমিশনার ঢাকার আদালতে ভারতের সখিনা বেগম, জামিন হয়নি শুনে অঝোরে কাঁদলেন মেয়ে নির্বাচনের আগে ঢাকা-১০সহ তিন আসনে হঠাৎ বিশেষ বরাদ্দ, কী বলছেন উপদেষ্টা?

স্বর্ণের দামের পতন: বৈশ্বিক প্রবণতা, বাংলাদেশি বাস্তবতা ও মুদ্রানীতি বিশ্লেষণ

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম টানা তিনবার বাড়ার পর অবশেষে কমানো হয়েছে। বাজুস ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিপ্রতি দাম ১,৮৯০ টাকা কমিয়ে ১,৯২,৯৬৯ টাকা করেছে। এই ঘোষণা বাজারে স্বস্তি আনার পাশাপাশি ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন বাস্তবতারও জন্ম দিয়েছে। তবে এ পরিবর্তন শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের কারণে নয়; বৈশ্বিক স্বর্ণবাজারের ওঠানামা, মার্কিন ডলারের শক্তি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি—সবকিছু একসাথে কাজ করছে।

আন্তর্জাতিক বাজারের প্রবণতা

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম দীর্ঘদিন ধরে ‘সেফ হেভেন অ্যাসেট’ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয়। তবে সম্প্রতি কয়েকটি কারণে দামের ভাটা দেখা গেছে—

  • মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের নীতি: সুদের হার বাড়ানোর ফলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণ থেকে সরে বন্ড ও অন্যান্য নিরাপদ সম্পদে ঝুঁকছেন।
  • ডলারের শক্তি: ডলার শক্তিশালী হলে স্বর্ণ কেনা তুলনামূলক ব্যয়বহুল হয়ে যায়, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে।
  • চীনের অর্থনীতি: বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ভোক্তা চীনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীরগতি স্বর্ণের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে।
  • ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা: ইউক্রেন যুদ্ধ বা মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার সময় স্বর্ণের দাম বাড়লেও, তা স্থায়ী হচ্ছে না; পরিস্থিতি শান্ত হলে দাম দ্রুত কমে আসছে।

এই প্রবণতা বাংলাদেশের বাজারেও সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক দামে পতন ঘটলেই বাজুসকে দাম সমন্বয় করতে হয়।

বাংলাদেশের বাজারে প্রতিফলন

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। টানা দামের বৃদ্ধির ফলে বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য স্বর্ণ কেনার প্রবণতা কমেছে। এবার সামান্য দাম কমায় বাজার কিছুটা প্রাণ ফিরে পেতে পারে। তবে স্বর্ণ এখনো একটি বিলাসী পণ্যই রয়ে গেছে।

এখানে আরও একটি বাস্তবতা কাজ করছে—বাংলাদেশের স্বর্ণবাজার আমদানিনির্ভর। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও, টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল না থাকলে দেশীয় বাজারে তা পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় না।

মুদ্রানীতির সঙ্গে সম্পর্ক

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি স্বর্ণের দামে পরোক্ষ প্রভাব ফেলে।

  • টাকার অবমূল্যায়ন: ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে গেলে স্বর্ণ আমদানির খরচ বেড়ে যায়।
  • রিজার্ভ সংকট: কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ডলার সংরক্ষণে কঠোর হয়, তখন স্বর্ণ আমদানিও কঠিন হয়, ফলে দাম বাড়তে থাকে।
  • মুদ্রাস্ফীতি: অভ্যন্তরীণ বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষ সঞ্চয়ের নিরাপদ উপায় হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে, এতে চাহিদা বেড়ে যায়।

অন্যদিকে, সুদের হার বাড়ালে ব্যাংকে সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ে এবং স্বর্ণের চাহিদা কিছুটা কমে। তাই মুদ্রানীতি ও স্বর্ণবাজারের মধ্যে একটি অদৃশ্য যোগসূত্র সবসময় সক্রিয় থাকে।

সাধারণ মানুষের জন্য তাৎপর্য

সাম্প্রতিক দামের পতন মধ্যবিত্তের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও তা এখনো বড় কোনো পরিবর্তন নয়। বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণ কেনার পরিকল্পনা থাকা অনেকেই হয়তো এখন কেনার দিকে ঝুঁকবেন। তবে অস্থিরতা এবং ঘন ঘন সমন্বয় তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি

জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, বর্তমান দাম কিছুটা স্বস্তি দিলেও আন্তর্জাতিক বাজার আবার চাঙ্গা হলে স্থানীয় দামে নতুন চাপ আসবে। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণকে এখনো সঞ্চয়ের নিরাপদ উপায় হিসেবে দেখছেন। দামের ওঠানামা তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে—দাম কমলে কিনে রাখা, দাম বাড়লে বিক্রি করা।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

  • যদি ডলারের দাম স্থিতিশীল হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম কমতে থাকে, তবে বাংলাদেশের বাজারেও আরও পতনের সম্ভাবনা রয়েছে।
  • তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বা অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে স্বর্ণ আবারও ‘সেফ হেভেন’ হয়ে উঠবে, তখন দাম বাড়তে পারে।
  • মুদ্রানীতির দিক থেকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার নীতি এবং সুদের হার নির্ধারণ সরাসরি প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশে স্বর্ণের দামের সাম্প্রতিক পতন কেবল স্থানীয় বাজারের ফল নয়; এর পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা এবং বাংলাদেশের মুদ্রানীতি। এটি দেখায়, স্বর্ণ কেবল গয়নার কাঁচামাল নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সূচক, যা স্থানীয় ভোক্তা থেকে শুরু করে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী পর্যন্ত সবার জন্য প্রভাব বিস্তার করে। আগামী দিনে দাম কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করবে বৈশ্বিক আর্থিক নীতি, ডলারের গতি এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর।

জনপ্রিয় সংবাদ

সৌদি আরবের চোখ ইসরায়েলের এফ-৩৫ সফলতা

স্বর্ণের দামের পতন: বৈশ্বিক প্রবণতা, বাংলাদেশি বাস্তবতা ও মুদ্রানীতি বিশ্লেষণ

১২:৪৯:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম টানা তিনবার বাড়ার পর অবশেষে কমানো হয়েছে। বাজুস ২২ ক্যারেট স্বর্ণের ভরিপ্রতি দাম ১,৮৯০ টাকা কমিয়ে ১,৯২,৯৬৯ টাকা করেছে। এই ঘোষণা বাজারে স্বস্তি আনার পাশাপাশি ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন বাস্তবতারও জন্ম দিয়েছে। তবে এ পরিবর্তন শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের কারণে নয়; বৈশ্বিক স্বর্ণবাজারের ওঠানামা, মার্কিন ডলারের শক্তি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি—সবকিছু একসাথে কাজ করছে।

আন্তর্জাতিক বাজারের প্রবণতা

আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম দীর্ঘদিন ধরে ‘সেফ হেভেন অ্যাসেট’ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয়। তবে সম্প্রতি কয়েকটি কারণে দামের ভাটা দেখা গেছে—

  • মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের নীতি: সুদের হার বাড়ানোর ফলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণ থেকে সরে বন্ড ও অন্যান্য নিরাপদ সম্পদে ঝুঁকছেন।
  • ডলারের শক্তি: ডলার শক্তিশালী হলে স্বর্ণ কেনা তুলনামূলক ব্যয়বহুল হয়ে যায়, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে।
  • চীনের অর্থনীতি: বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ভোক্তা চীনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীরগতি স্বর্ণের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে।
  • ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা: ইউক্রেন যুদ্ধ বা মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনার সময় স্বর্ণের দাম বাড়লেও, তা স্থায়ী হচ্ছে না; পরিস্থিতি শান্ত হলে দাম দ্রুত কমে আসছে।

এই প্রবণতা বাংলাদেশের বাজারেও সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক দামে পতন ঘটলেই বাজুসকে দাম সমন্বয় করতে হয়।

বাংলাদেশের বাজারে প্রতিফলন

বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। টানা দামের বৃদ্ধির ফলে বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য স্বর্ণ কেনার প্রবণতা কমেছে। এবার সামান্য দাম কমায় বাজার কিছুটা প্রাণ ফিরে পেতে পারে। তবে স্বর্ণ এখনো একটি বিলাসী পণ্যই রয়ে গেছে।

এখানে আরও একটি বাস্তবতা কাজ করছে—বাংলাদেশের স্বর্ণবাজার আমদানিনির্ভর। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও, টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল না থাকলে দেশীয় বাজারে তা পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় না।

মুদ্রানীতির সঙ্গে সম্পর্ক

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি স্বর্ণের দামে পরোক্ষ প্রভাব ফেলে।

  • টাকার অবমূল্যায়ন: ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে গেলে স্বর্ণ আমদানির খরচ বেড়ে যায়।
  • রিজার্ভ সংকট: কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ডলার সংরক্ষণে কঠোর হয়, তখন স্বর্ণ আমদানিও কঠিন হয়, ফলে দাম বাড়তে থাকে।
  • মুদ্রাস্ফীতি: অভ্যন্তরীণ বাজারে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষ সঞ্চয়ের নিরাপদ উপায় হিসেবে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকে, এতে চাহিদা বেড়ে যায়।

অন্যদিকে, সুদের হার বাড়ালে ব্যাংকে সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ে এবং স্বর্ণের চাহিদা কিছুটা কমে। তাই মুদ্রানীতি ও স্বর্ণবাজারের মধ্যে একটি অদৃশ্য যোগসূত্র সবসময় সক্রিয় থাকে।

সাধারণ মানুষের জন্য তাৎপর্য

সাম্প্রতিক দামের পতন মধ্যবিত্তের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও তা এখনো বড় কোনো পরিবর্তন নয়। বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বর্ণ কেনার পরিকল্পনা থাকা অনেকেই হয়তো এখন কেনার দিকে ঝুঁকবেন। তবে অস্থিরতা এবং ঘন ঘন সমন্বয় তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি

জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, বর্তমান দাম কিছুটা স্বস্তি দিলেও আন্তর্জাতিক বাজার আবার চাঙ্গা হলে স্থানীয় দামে নতুন চাপ আসবে। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণকে এখনো সঞ্চয়ের নিরাপদ উপায় হিসেবে দেখছেন। দামের ওঠানামা তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে—দাম কমলে কিনে রাখা, দাম বাড়লে বিক্রি করা।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

  • যদি ডলারের দাম স্থিতিশীল হয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম কমতে থাকে, তবে বাংলাদেশের বাজারেও আরও পতনের সম্ভাবনা রয়েছে।
  • তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বা অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে স্বর্ণ আবারও ‘সেফ হেভেন’ হয়ে উঠবে, তখন দাম বাড়তে পারে।
  • মুদ্রানীতির দিক থেকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার নীতি এবং সুদের হার নির্ধারণ সরাসরি প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশে স্বর্ণের দামের সাম্প্রতিক পতন কেবল স্থানীয় বাজারের ফল নয়; এর পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা এবং বাংলাদেশের মুদ্রানীতি। এটি দেখায়, স্বর্ণ কেবল গয়নার কাঁচামাল নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সূচক, যা স্থানীয় ভোক্তা থেকে শুরু করে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী পর্যন্ত সবার জন্য প্রভাব বিস্তার করে। আগামী দিনে দাম কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করবে বৈশ্বিক আর্থিক নীতি, ডলারের গতি এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর।