জাপানের প্রতিরক্ষা নীতির নতুন মোড়
জাপান প্রথমবারের মতো লাইসেন্সের আওতায় তৈরি প্যাট্রিয়ট অ্যাডভান্সড ক্যাপেবিলিটি-৩ (PAC-3) ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি সম্পন্ন করেছে। টোকিওতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে চিফ কেবিনেট সেক্রেটারি মিনোরু কিহারা নিশ্চিত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে ২০২৪ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তির ভিত্তিতে জাপানের এয়ার সেল্ফ-ডিফেন্স ফোর্সে থাকা ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অন্যান্য ফ্রন্টে ব্যবহৃত মার্কিন মজুদ পুনর্গঠনে সহায়তা করা হবে, অথচ জাপানের নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বজায় থাকবে। সরকার এটিকে দেখাচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা হিসেবে, যেখানে দেশটি সরাসরি ইউক্রেনে মারাত্মক অস্ত্র পাঠাচ্ছে না, কিন্তু ঘনিষ্ঠ মিত্রকে সহায়তা করছে।
কিহারা স্পষ্ট করেছেন, রপ্তানিকৃত ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে; তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো হবে না। এই ভাষ্য মূলত জাপানের “পরোক্ষ সহায়তা” নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্যই। তা সত্ত্বেও বাস্তবে এই রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ও মজুদচাপ কমিয়ে ইউক্রেনের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে সরবরাহ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করছে, এমন ধারণা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের। সরকারের যুক্তি, বর্তমান নিরাপত্তা পরিবেশে মিত্রতার দায় ভাগ করে নিতে এবং জাপানের নিজস্ব প্রতিরোধশক্তি জোরদার করতে এ ধরনের সমন্বয় এখন অপরিহার্য।
PAC-3 হলো জাপানের বহুস্তরীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ আঞ্চলিক হুমকি মোকাবিলায় ব্যবহার হয়। লাইসেন্সের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্র রপ্তানি করে টোকিও এক অর্থে দেখাচ্ছে যে, সামনের দিনগুলোতে মিত্রদের সরবরাহ শৃঙ্খলেও সে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হতে চায়। প্রতিরক্ষা আমলাদের ভাষ্য, সংকটে পড়লে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো এখন জাপানের শিল্পভিত্তিক সহায়তার ওপরও বেশি নির্ভর করতে পারবে।

দেশের ভেতরে এই রপ্তানিকে অনেকেই ২০১৪ সালের সাংবিধানিক ব্যাখ্যা পরিবর্তনের ধারাবাহিক ফল হিসেবে দেখছেন। সে সময় সীমিত সমষ্টিগত আত্মরক্ষার অনুমতি দিয়ে যুদ্ধোত্তর শান্তিবাদী কাঠামোয় একটি বড় পরিবর্তন আনা হয়। পরে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম হস্তান্তরের নির্দেশিকা সংশোধন করে লাইসেন্সভিত্তিক রপ্তানির সুযোগ তৈরি হয়। বর্তমান সরকারের কাছে PAC-3 রপ্তানি তাই এক ধরনের প্রমাণ, যে তারা প্রতিশ্রুত নিরাপত্তা সংস্কার বাস্তবায়নে এগোচ্ছে, যদিও সংবিধানিক সীমারেখা পুরোপুরি ভাঙছে না।
আঞ্চলিক বার্তা ও বিতর্ক
টোকিও বলছে, PAC-3 রপ্তানির মাধ্যমে জাপান-যুক্তরাষ্ট্র জোট আরও দৃঢ় হচ্ছে এবং এতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতাও বাড়বে। ইউক্রেন যুদ্ধ, উত্তর কোরিয়ার বারবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এবং তাইওয়ান নিয়ে চীনের চাপ—সব মিলিয়ে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি বজায় রাখা এখন জাপানের নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের মজুদ পুনর্গঠনে সহায়তা করা, জাপানের মতে, কেবল মিত্রতার অংশই নয়; এটি ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর প্রতীকও।
তবে সমালোচকরা মনে করেন, অস্ত্র রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে শিথিল হওয়ায় ভবিষ্যতে সীমানা কোথায় টানা হবে, তা ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছু আইনবিদ ও বিরোধী রাজনীতিকের অভিযোগ, সরকার বাস্তবে সংবিধানের শান্তিবাদী চেতনার সীমানা ঠেলে দিচ্ছে। তাদের যুক্তি, যুদ্ধরত একটি দেশকে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র না পাঠালেও, সেই দেশের মিত্রের মজুদ পূরণে অংশ নেওয়া কার্যত একই ফল তৈরি করছে এবং এতে জাপান নিজেও বৈরী রাষ্ট্রের রোষানলে পড়তে পারে।

নিরাপত্তা মহল তার পাল্টা জবাবে বলছে, উত্তরোত্তর সংকটপূর্ণ বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে পুরনো শূন্য-সহিষ্ণু নীতি ধরে রাখা বাস্তবসম্মত নয়। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ, উত্তর কোরিয়ার ধারাবাহিক ব্যালিস্টিক পরীক্ষা, এবং তাইওয়ান প্রণালিতে শক্তি প্রদর্শনের প্রেক্ষাপটে মিত্র দেশগুলোকে পরস্পরকে দৃশ্যমান সহায়তা দিতেই হবে। তাদের কাছে PAC-3 রপ্তানি কোনো ‘বিপ্লবী’ পরিবর্তন নয়; বরং জাপান যে অল্পস্বল্প হলেও যুগের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে, তার ইঙ্গিত।
আগামী বছরগুলোতে জাপানের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র, জাহাজ ও যুদ্ধবিমান প্রকল্পে আরও বিনিয়োগ বাড়ালে, যৌথ উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনাও তীব্র হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তখন প্রশ্ন উঠবে, কোন কোন ক্ষেত্রে জাপান লাইসেন্সভিত্তিক অংশীদার থাকবে, আর কোথায় পূর্ণাঙ্গ রপ্তানিকারক হয়ে উঠবে। এ কারণে তুলনামূলক ছোট এই PAC-3 ডিলকেও পর্যবেক্ষকরা দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা পরিচয় পরিবর্তনের একটি মাইলফলক হিসেবেই দেখছেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















