ছোট ফেনী নদীর ভাঙনে আতঙ্ক
ছোট ফেনী নদীর তীরবর্তী তিনটি উপজেলা—কোম্পানীগঞ্জ, দাগনভূঞা ও সোনাগাজীর মানুষ এখন ভাঙনের ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ভয়াবহ ভাঙনে জমি, ফসলি ক্ষেত, ফলের বাগান, রাস্তা ও শত শত ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে।
স্থানীয়দের হিসাবে প্রায় ৪১ হাজার হেক্টর আবাদি জমি ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। আরও ৩০ হাজার হেক্টর জমি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর পাশাপাশি বাড়িঘর, বাজার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ভাঙনের হুমকিতে আছে।
মানববন্ধন ও দাবি
গত ১৫ সেপ্টেম্বর সোনাগাজীর চরমজলিশপুর ইউনিয়নের বাদারপুর গ্রামের শতাধিক মানুষ ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেন। তারা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ঘরবাড়ি, মসজিদ ও আশপাশের জমি রক্ষার দাবি জানান।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, বড় একটি প্রকল্পের আওতায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে ঠিকাদার এলাকায় অবস্থান করলেও কার্যকর কোনো কাজ শুরু হয়নি। এমনকি জিও ব্যাগও ফেলা হয়নি। বরং ঠিকাদার নানা অজুহাত দেখিয়ে সময়ক্ষেপণ করছে।

ভাঙনের ভয়াবহ চিত্র
এদিকে বিভিন্ন সড়ক ধসে পড়ছে, বাড়িঘরে ফাটল দেখা দিয়েছে, পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা—এভাবে চলতে থাকলে গোটা গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চর দরবেশ, উত্তর-পশ্চিম চর দরবেশ, চর সাহাভিখারি, চর ইঞ্জিমান, তালতলি, তেল্লারঘাট, ফকিরাপুল ও ইতালি বাজার ভাঙনের শিকার। চর মজলিশপুর ইউনিয়নের বাদারপুর ও মিয়াজীর ঘাটেও ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে।
বগদানা ইউনিয়নের জেলেপাড়া, কুঠিরহাট, কাতাখিলা, কালিমন্দির, আওরারখিল, আদর্শগ্রাম, কাজীরহাট স্লুইসগেট, আলমপুর, ধনিপাড়া ও সাহেবের ঘাট ভাঙনে বিপর্যস্ত।
দাগনভূঞা উপজেলার ভাষাশহীদ সালাম নগর এবং নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের মুচাপুর, মাছাঘোনা, পূর্ব চর হাজারী ও পূর্ব চর পার্বতী গ্রামেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ঘরবাড়ি ও জীবিকা হারানো মানুষ
শত শত সেমিপাকা ও পাকা ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। রাতারাতি ঘর, গাছপালা ও বাগান ভেঙে যাচ্ছে। অনেকেই ঘরের যা অবশিষ্ট আছে তা খুলে নিয়ে অস্থায়ী আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বাঁশ ও গাছ দিয়ে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু এগুলো কার্যকর হচ্ছে না।
বিশেষত উত্তর-পশ্চিম চর দরবেশ, কাজীরহাট, আওরারখিল, দাসপাড়া, কাতাখিলা ও কুঠিরহাট এলাকায় নদী দিনরাত একনাগাড়ে এগিয়ে আসছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের কণ্ঠে হতাশা
মজনিশপুর ইউনিয়নের বাদারপুর গ্রামের মনোয়ারা কেঁদে বলেন, “নদী আমাদের ঘর কেড়ে নিয়েছে।”
একই গ্রামের সেন্টু মিয়া জানান, অনেক পরিবার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি বলেন, “দুই মাসে শত শত মানুষ গৃহহীন হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে, অথচ কেউ খোঁজও নিচ্ছে না।”

চর গোপালগঞ্জের কামাল উদ্দিন বলেন, ছোট ফেনী নদী তার গ্রামের পশ্চিম দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বন্যার পর স্রোত অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে দুই-তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন ধরেছে। “দশ বছর আগে আমার ঘর ভেসে গেছে। এখন অন্যের জমিতে থাকি। গ্রামের অর্ধেক অংশ চলে গেছে। জরুরি ব্যবস্থা না নিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আরও ঘরবাড়ি হারিয়ে যাবে।”
একই এলাকার মেঘনাথ চন্দ্র দাস জানান, মানুষ বালুর বস্তা, বাঁশ ও গাছ দিয়ে ঘর রক্ষার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেগুলো কোনো কাজ করছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্যাখ্যা
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনী অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, ছোট ফেনী, ফেনী ও কালিদাস পাহালিয়াখাল নদীতে ভাঙন চলছে। প্রায় ১৩ কিলোমিটার নদীর তীর এখন ঝুঁকিতে।
তিনি জানান, একনেক সম্প্রতি ‘বি স্ট্রং’ নামের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৭১ কোটি টাকার এই প্রকল্পে তিন নদীর ঝুঁকিপূর্ণ তীর বাঁধাইয়ের কাজ হবে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার মেরামতকাজ ১১৬টি স্থানে সম্পন্ন হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মুচাপুর রেগুলেটরও সরকারি উদ্যোগে পুনর্নির্মাণ করা হবে।

ভরসার অপেক্ষায় গ্রামবাসী
গ্রামবাসীর আশা, এই প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়িত হলে ভাঙনে ক্ষতি কিছুটা হলেও থামবে। ঘরবাড়ি ও জমিজমা রক্ষা পাবে, আবারও নিরাপত্তা ফিরে আসবে তাদের জীবনে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















