কলকাতা: করমর্দন এড়ানো, সংবাদ সম্মেলন বাতিল, টুর্নামেন্ট থেকে সরে দাঁড়ানোর হুমকি দিয়ে পরে আবার ফিরিয়ে নেওয়া, খেলোয়াড়দের অশোভন অঙ্গভঙ্গি ও বক্তব্যের জন্য জরিমানা—ভারত-পাকিস্তান ম্যাচকে ঘিরে কখনও এত দীর্ঘ এবং টানটান উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়নি, যেমনটি দেখা যাচ্ছে দুবাইয়ে রবিবারের এশিয়া কাপ ফাইনালকে ঘিরে।
সামগ্রিকভাবে দেখলে ভারতের চিন্তার কোনো কারণ নেই। আগের দুই ম্যাচেই পাকিস্তানকে হেভিওয়েট জয়ে উড়িয়ে দিয়েছে তারা। কিন্তু ফাইনালের ম্যাচে প্রায়ই স্নায়ুচাপে ফলাফল বদলে যায়, আর পাকিস্তান হয়তো ভাবছে—তৃতীয়বার হয়তো তাদের ভাগ্য ফিরতে পারে।
এশিয়া কাপের ৪১ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তান বিশ্বাস করতে চাইছে তারা ধীরে ধীরে ছন্দে ফিরছে। ভারত জানে, শুক্রবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হার তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কাগজে-কলমে দুই দল সমান নয়, কিন্তু ভারত-পাকিস্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখনও শুধু কাগজের হিসেব-নিকেশে সীমাবদ্ধ থাকেনি। পাকিস্তান হয়তো দাবি করতে চাইবে, ভারতের কাছে দুই হারই তাদের শেখার প্রক্রিয়ার অংশ, যা শেষ পর্যন্ত বড় জয়ের পথ তৈরি করবে।
এর জন্য পাকিস্তানকে বড় ইনিংস খেলতে হবে। প্রথম ম্যাচে তারা কেবল পাওয়ারপ্লে-তেই ভালো ব্যাট করেছিল, পরে ভারতের স্পিনাররা খেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। দ্বিতীয় ম্যাচে খানিকটা উন্নতি দেখা যায়—অর্ধেক ওভারে ৯১/১ পৌঁছালেও পরে আবার ভেঙে পড়ে।
পাকিস্তান শুরু থেকেই জোরে খেলতে চাইলেও ভারতের বিপক্ষে জিততে হলে মিডল ওভারগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে, যখন বল হাতে থাকবেন বরুণ চক্রবর্তী, কুলদীপ যাদব ও অক্ষর প্যাটেল। এই ত্রয়ী এখন পর্যন্ত ২২টি উইকেট নিয়েছেন ৬.৪৩ ইকোনমি রেটে—যা পাকিস্তানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
জসপ্রিত বুমরাহ ফিরছেন, আর ভারত চাইবে না জেতা একাদশে পরিবর্তন আনতে। মানে হার্দিক পাণ্ডিয়াই নতুন বলে শুরু করবেন, শিবম দুবে থাকবেন ব্যাকআপ। দুবেকে আবার মিডল ওভারে ব্যাটিং শক্তি বাড়ানোর ভূমিকায় দেখা যেতে পারে, অক্ষর থাকবেন ফ্লোটার হিসেবে।
সঞ্জু স্যামসনকে ভারত কিভাবে ব্যবহার করে, তা দেখার বিষয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁর দুর্দান্ত ইনিংস নজর কেড়েছে। সাধারণত হার্দিককে নীচের দিকে ভরসা হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু ভারতের প্রয়োজন মাঝের দিকে একজন ডানহাতি হিটার, যিনি কয়েক বলেই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারবেন। বিশেষ করে অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন না বলে, তাই এ ম্যাচে তাকেও বড় ভূমিকা নিতে হবে।
এশিয়া কাপে নয়, গোটা বছরেই সূর্যকুমারের স্ট্রাইক রেট মাত্র ১১০—যা তাঁর উদ্ভাবনী ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতির সঙ্গে বেমানান। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৪৭ রানের ইনিংস বিশেষ ছিল, কিন্তু অন্যান্য ম্যাচে তাঁর ব্যর্থতা এখন চিন্তার বিষয়।
রানের চেয়ে বেশি চোখে পড়ছে তাঁর সংগ্রাম। যখন সবাই ধীরে ধীরে দুবাইয়ের দুই-গতি পিচ ও ধীর আউটফিল্ডে মানিয়ে নিয়েছে, সূর্য সেখানে আটকে যাচ্ছেন। তাই ফাইনালটাই হতে পারে তাঁর জন্য নিজেকে ফিরে পাওয়ার সুযোগ। শুক্রবার ছাড়া ভারতের ব্যাটিং নিখুঁত নয়। ওপেনারদের বাইরে ভারতের কোনো ব্যাটসম্যানের স্ট্রাইক রেট ১৩২-এর ওপরে নয়, এমনকি দুর্বল দলের বিরুদ্ধেও। হয়তো নিয়মিত অদলবদল ব্যাটসম্যানদের মানসিকতায় প্রভাব ফেলছে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ শেষে ভারতের বোলিং কোচ মর্নে মরকেল বলেন, স্ট্রাইক রোটেশনই ব্যাটিংয়ের শুরুটা ভালো করার চাবিকাঠি। “কঠিন পরিস্থিতিতে কী আমরা স্ট্রাইকটা একটু ভালোভাবে রোটেট করতে পারি? পার্টনারশিপ বাঁচাতে পারি? নতুন ব্যাটসম্যানের জন্য শুরু করা কঠিন, কিন্তু মানসিকতায় আক্রমণাত্মক থাকতে হবে।”
অভিষেক শর্মা একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি অটোপাইলটে ব্যাট করছেন। ভারতের আবারও তাঁর প্রয়োজন শুভমান গিলের সঙ্গে ইনিংস গড়ে দেওয়ার জন্য। টানা তিনটি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন তিনি, অন্তত দুইবার সেঞ্চুরির দিকেও এগোচ্ছিলেন। তাঁর ব্যাটিং দেখে সনৎ জয়সুরিয়াও প্রশংসা করেছেন, বলেছেন অভিষেক জানেন কিভাবে নিজের ইনিংসের গতি ঠিক রাখতে হয়।
শুক্রবারের ম্যাচের পর শ্রীলঙ্কার কোচ বলেছিলেন, “যখনই ও একটু ধীরে খেলতে চায়, ঠিক জানে কিভাবে করতে হয়। পাওয়ারপ্লের পর ছয় ওভারের শেষে যদি দীর্ঘ সময় খেলতে চায়, সেটাও করছে। তাই দিনে দিনে আরও রান করছে, আরও ভালো ব্যাট করছে।”
তবে গড় হিসেবের নিয়ম এবার অভিষেকের বিপরীতেও কাজ করতে পারে। শুরুতে দারুণ করলেও ভারত সবসময় দ্বিতীয়ার্ধে ব্যাটিংয়ে কাঙ্ক্ষিত ঝলক দেখাতে পারেনি। আর শেষ ম্যাচে পাকিস্তান বুমরাহ-র বিপক্ষে ৪৫ রান তুলেছিল।
ভারত এতদিন উত্তেজিত হলেও ভেঙে পড়েনি। কিন্তু পাকিস্তান এত সুযোগ আগে কখনও পায়নি নিজেদের ব্যর্থতা থেকে শিখে নেওয়ার। এ কারণেই ফাইনালে ভারতকে পুরোপুরি অপ্রতিরোধ্য বলা যাচ্ছে না।