০৭:৫০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
ওয়াটসঅ্যাপ অ্যাপল এর প্রাচীর ভেঙে ফেলছে সৌদি আরবের চোখ ইসরায়েলের এফ-৩৫ সফলতা ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন পরিকল্পনা: ইউক্রেন যুদ্ধে সমাপ্তি আনার চেষ্টা নাইজেরিয়ান ফটোগ্রাফার জে.ডি. ওজেইকিরে-এর অদেখা ছবি প্রকাশ বড় জয়, অস্বস্তিকর মুহূর্ত আর আবেগ—২০২৫ ARIA Awards ছিল টালমাটাল কিন্তু জীবন্ত  কমছে মার্কিনদের ছুটির কেনাকাটা, চাপের মুখে খুচরা বিক্রেতারা  অতিরিক্ত ক্ষমতা ও প্রযুক্তি বদলে বড় ধাক্কার মুখে ভারতের সোলার মডিউল শিল্প  জাপানের PAC-3 ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি, নিরাপত্তা নীতিতে নতুন ধাপ পুলিশের মনোবল ভাঙলে আবার নিজেকে নিজেই পাহারা দিতে হবে: ডিএমপি কমিশনার ঢাকার আদালতে ভারতের সখিনা বেগম, জামিন হয়নি শুনে অঝোরে কাঁদলেন মেয়ে

গড়াই নদী: পদ্মার গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে যা সৃষ্টি হয়েছিলো

নদীর উৎপত্তি ও ভৌগোলিক বিস্তার

গড়াই নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক নদী। এটি পদ্মা নদীর প্রধান শাখাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর থেকে গড়াই নদীর উৎপত্তি। এরপর এটি কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর ও নড়াইল জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নবগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮০ কিলোমিটার হলেও বিভিন্ন সময়ে খাল-নালা, ছোট উপনদী ও খড়ি যোগ হওয়ায় এর বিস্তার আরও বেড়েছে।

ভূগোলবিদদের মতে, গড়াই নদীর অস্তিত্ব পদ্মার গতিপথের পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। পদ্মা যখন তার মূল স্রোতপথ থেকে বাঁক নিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন এর একটি বড় অংশ গড়াই নদীর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গিয়ে পৌঁছায়। ফলে নদীটি শুধু একটি শাখা নদী নয়, বরং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত একটি মূলধারার নদী হিসেবে পরিচিতি পায়।

নদীর দুই তীর জুড়ে কৃষিজমি, জনবসতি ও ছোট-বড় বাজার গড়ে উঠেছে। কুষ্টিয়া থেকে ঝিনাইদহ পর্যন্ত গড়াই নদী ছিল একটি বড় আকারের নদীপথ। মাগুরা, যশোর ও নড়াইল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে নদীটি নবগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়ায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়েছে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

গড়াই নদীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলার প্রাচীন বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ নদীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক আমলে নদীটি ছিল কলকাতা, ফরিদপুর ও খুলনার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। বিশেষ করে নীলচাষ ও পাট বাণিজ্যের সময় গড়াই নদী ব্যবহার করে নীলকুঠির পণ্য কলকাতায় পাঠানো হতো।

ব্রিটিশ আমলে গড়াই নদীর ওপর নির্ভর করেই এ অঞ্চলের চিনিকল, তাঁতশিল্প ও হাট-বাজার পরিচালিত হতো। কুষ্টিয়ার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের আগে পর্যন্ত এ নদীর ওপর দিয়ে স্টিমার চলাচল ছিল নিয়মিত। নদী বেয়ে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও যশোরের কৃষিপণ্য কলকাতায় পৌঁছে যেত। নদীপথে নৌযান চলাচলের কারণে এ অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছিল।

স্থানীয় ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেন, মোগল আমলেও গড়াই নদী দিয়ে নৌযান চলাচল করত। কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ধান, লবণ, তেল, পাট, মাছ এবং কাপড় এ নদীর মাধ্যমে কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছত। ফলে গড়াই নদী শুধু একটি প্রাকৃতিক জলাধার নয়, বরং বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

নদী ও জীববৈচিত্র্য

গড়াই নদী একসময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল। নদীটিতে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। ইলিশ, কাতলা, রুই, মৃগেল, বোয়াল, শোল, মাগুর, টেংরা, কৈ, শিং, পাবদা—এসব মাছ একসময় এই নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা এ নদীর উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

নদীর জলে শুধু মাছ নয়, ছিল নানা জলজ উদ্ভিদ। কচুরিপানা, শাপলা, পদ্মফুল নদীর জলকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করত। বর্ষার মৌসুমে নদীর দুই তীরে সবুজাভ প্রাকৃতিক দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করত। গড়াই নদীর পানি ছিল সেচের জন্য অপরিহার্য। নদী তীরবর্তী জমিগুলো এ পানির কারণে উর্বর হতো। ধান, পাট, শাকসবজি ও নানা কৃষিজ ফসল উৎপাদনে এ নদীর পানি ছিল আশীর্বাদস্বরূপ।

এছাড়াও নদীর পানির সঙ্গে জড়িত ছিল প্রাণীকুলের জীবন। জলচর পাখি যেমন বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, গাংচিল, চিল এ নদীকে আশ্রয় করত। প্রজনন মৌসুমে নদীর পাড়ে হাজারো পাখির সমাগম হতো। ফলে গড়াই নদী শুধু মানুষের জন্য নয়, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা

বাংলার গ্রামীণ সমাজে নদী শুধু পানি বহনকারী নয়, বরং সংস্কৃতি ও জীবনের অংশ। গড়াই নদীও তেমনই একটি নদী, যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলেছে। নদীর তীরে বসেই স্থানীয় মানুষ হাট-বাজার গড়ে তুলেছিল। বর্ষাকালে নদী ভেসে যেত নৌকাবাইচের ঢেউয়ে।

লোকসংগীত, পালাগান ও কবিগান প্রায়ই গড়াই নদীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। গ্রামীণ কবি ও গায়কেরা নদীর সৌন্দর্য, স্রোত, মাছ ধরা ও নৌযাত্রাকে গানের ভাষায় তুলে ধরেছেন। নদীর ঘাটে সন্ধ্যাবেলায় ভাটিয়ালি গান শোনার প্রচলন ছিল।

এছাড়াও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও গড়াই নদীর পানি ব্যবহৃত হতো। দুর্গাপূজা, ছট পূজা, মহরম বা বিভিন্ন গ্রামীণ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে এ নদীর জলকে পবিত্র ধরা হতো। স্থানীয় মানুষের জন্ম-মৃত্যু, উৎসব-পার্বণ সবকিছুর সঙ্গে নদী ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

নদীর অবক্ষয় ও সংকট

একসময় প্রমত্ত গড়াই নদী আজ মৃতপ্রায়। পদ্মার স্রোত পরিবর্তন এবং নদীর উজানে বিভিন্ন বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে গড়াই নদীর পানিপ্রবাহ দিন দিন হ্রাস পেয়েছে। বর্ষার মৌসুমে কিছু পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে নদী প্রায় খাল-নালার মতো হয়ে যায়।

নদীর তলদেশে অতিরিক্ত পলি পড়ায় এর নাব্যতা কমে গেছে। এর ফলে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জলজ উদ্ভিদ ও মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্তির পথে।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, নদীর এ অবস্থা মানবসৃষ্ট। সঠিকভাবে নদীর প্রবাহ বজায় না রাখায় এবং অযত্নে ফেলে রাখার কারণে আজ এ নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। নদী দখল, নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ এবং অপরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থাও নদীর অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

কৃষি ও অর্থনীতিতে প্রভাব

গড়াই নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে কৃষকরা সহজেই নদীর পানি ব্যবহার করে সেচ দিতেন। এখন তারা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে কৃষকেরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

এছাড়া নদীপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় অর্থনীতির গতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। একসময় নদী বেয়ে কুষ্টিয়া ও যশোরের বাজারে পণ্য যেত। আজ সবকিছু সড়কপথের ওপর নির্ভর করছে। এতে সময় ও খরচ দুটোই বেড়েছে। ছোট ছোট হাট-বাজার ও নৌঘাটগুলো বিলুপ্ত হয়েছে। স্থানীয় অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

যদিও গড়াই নদী আজ মৃতপ্রায়, তবু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এটিকে পুনর্জীবিত করা সম্ভব। সঠিক নদী-সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা হলে নদীতে আবারও প্রাণ ফিরতে পারে। নদী খনন, ড্রেজিং ও বাঁধ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

এছাড়া নদী ব্যবহারের জন্য আধুনিক পরিকল্পনা নিতে হবে। নদী যদি পুনর্জীবিত হয় তবে সেচ ব্যবস্থায় উন্নতি হবে, কৃষি খরচ কমবে এবং মাছ উৎপাদন বাড়বে। একই সঙ্গে নৌপথ চালু হলে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। পর্যটন খাতেও এ নদীকে ব্যবহার করা সম্ভব। নৌকাবাইচ, নদীপাড়ে অবকাশকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠতে পারে।

পরিবেশবিদরা বলেন, নদী বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে। গড়াই নদীর পুনর্জাগরণ শুধু অর্থনীতিই নয়, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকেও রক্ষা করবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকেও সচেতন হতে হবে। নদীকে দখলমুক্ত রাখা, অপরিকল্পিত বাঁধ বন্ধ করা এবং সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

গড়াই নদী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনে অমূল্য সম্পদ। একসময় এটি ছিল অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশের প্রাণ। আজ এটি মৃতপ্রায় হলেও, সঠিক উদ্যোগ নিলে গড়াই নদীকে আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। নদী কেবল পানির উৎস নয়, এটি একটি সভ্যতার প্রতীক। গড়াই নদীর পুনর্জাগরণ মানে স্থানীয় মানুষের আশা, জীবিকা ও ইতিহাসকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলা।

জনপ্রিয় সংবাদ

ওয়াটসঅ্যাপ অ্যাপল এর প্রাচীর ভেঙে ফেলছে

গড়াই নদী: পদ্মার গতিপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে যা সৃষ্টি হয়েছিলো

১০:০০:৪৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নদীর উৎপত্তি ও ভৌগোলিক বিস্তার

গড়াই নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক নদী। এটি পদ্মা নদীর প্রধান শাখাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর থেকে গড়াই নদীর উৎপত্তি। এরপর এটি কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর ও নড়াইল জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নবগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮০ কিলোমিটার হলেও বিভিন্ন সময়ে খাল-নালা, ছোট উপনদী ও খড়ি যোগ হওয়ায় এর বিস্তার আরও বেড়েছে।

ভূগোলবিদদের মতে, গড়াই নদীর অস্তিত্ব পদ্মার গতিপথের পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। পদ্মা যখন তার মূল স্রোতপথ থেকে বাঁক নিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন এর একটি বড় অংশ গড়াই নদীর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গিয়ে পৌঁছায়। ফলে নদীটি শুধু একটি শাখা নদী নয়, বরং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত একটি মূলধারার নদী হিসেবে পরিচিতি পায়।

নদীর দুই তীর জুড়ে কৃষিজমি, জনবসতি ও ছোট-বড় বাজার গড়ে উঠেছে। কুষ্টিয়া থেকে ঝিনাইদহ পর্যন্ত গড়াই নদী ছিল একটি বড় আকারের নদীপথ। মাগুরা, যশোর ও নড়াইল পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে নদীটি নবগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়ায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়েছে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

গড়াই নদীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলার প্রাচীন বাণিজ্যিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় এ নদীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক আমলে নদীটি ছিল কলকাতা, ফরিদপুর ও খুলনার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। বিশেষ করে নীলচাষ ও পাট বাণিজ্যের সময় গড়াই নদী ব্যবহার করে নীলকুঠির পণ্য কলকাতায় পাঠানো হতো।

ব্রিটিশ আমলে গড়াই নদীর ওপর নির্ভর করেই এ অঞ্চলের চিনিকল, তাঁতশিল্প ও হাট-বাজার পরিচালিত হতো। কুষ্টিয়ার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের আগে পর্যন্ত এ নদীর ওপর দিয়ে স্টিমার চলাচল ছিল নিয়মিত। নদী বেয়ে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও যশোরের কৃষিপণ্য কলকাতায় পৌঁছে যেত। নদীপথে নৌযান চলাচলের কারণে এ অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছিল।

স্থানীয় ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেন, মোগল আমলেও গড়াই নদী দিয়ে নৌযান চলাচল করত। কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ধান, লবণ, তেল, পাট, মাছ এবং কাপড় এ নদীর মাধ্যমে কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চলে পৌঁছত। ফলে গড়াই নদী শুধু একটি প্রাকৃতিক জলাধার নয়, বরং বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।

নদী ও জীববৈচিত্র্য

গড়াই নদী একসময় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল। নদীটিতে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। ইলিশ, কাতলা, রুই, মৃগেল, বোয়াল, শোল, মাগুর, টেংরা, কৈ, শিং, পাবদা—এসব মাছ একসময় এই নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা এ নদীর উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

নদীর জলে শুধু মাছ নয়, ছিল নানা জলজ উদ্ভিদ। কচুরিপানা, শাপলা, পদ্মফুল নদীর জলকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করত। বর্ষার মৌসুমে নদীর দুই তীরে সবুজাভ প্রাকৃতিক দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করত। গড়াই নদীর পানি ছিল সেচের জন্য অপরিহার্য। নদী তীরবর্তী জমিগুলো এ পানির কারণে উর্বর হতো। ধান, পাট, শাকসবজি ও নানা কৃষিজ ফসল উৎপাদনে এ নদীর পানি ছিল আশীর্বাদস্বরূপ।

এছাড়াও নদীর পানির সঙ্গে জড়িত ছিল প্রাণীকুলের জীবন। জলচর পাখি যেমন বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, গাংচিল, চিল এ নদীকে আশ্রয় করত। প্রজনন মৌসুমে নদীর পাড়ে হাজারো পাখির সমাগম হতো। ফলে গড়াই নদী শুধু মানুষের জন্য নয়, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা

বাংলার গ্রামীণ সমাজে নদী শুধু পানি বহনকারী নয়, বরং সংস্কৃতি ও জীবনের অংশ। গড়াই নদীও তেমনই একটি নদী, যা এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলেছে। নদীর তীরে বসেই স্থানীয় মানুষ হাট-বাজার গড়ে তুলেছিল। বর্ষাকালে নদী ভেসে যেত নৌকাবাইচের ঢেউয়ে।

লোকসংগীত, পালাগান ও কবিগান প্রায়ই গড়াই নদীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। গ্রামীণ কবি ও গায়কেরা নদীর সৌন্দর্য, স্রোত, মাছ ধরা ও নৌযাত্রাকে গানের ভাষায় তুলে ধরেছেন। নদীর ঘাটে সন্ধ্যাবেলায় ভাটিয়ালি গান শোনার প্রচলন ছিল।

এছাড়াও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও গড়াই নদীর পানি ব্যবহৃত হতো। দুর্গাপূজা, ছট পূজা, মহরম বা বিভিন্ন গ্রামীণ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে এ নদীর জলকে পবিত্র ধরা হতো। স্থানীয় মানুষের জন্ম-মৃত্যু, উৎসব-পার্বণ সবকিছুর সঙ্গে নদী ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

নদীর অবক্ষয় ও সংকট

একসময় প্রমত্ত গড়াই নদী আজ মৃতপ্রায়। পদ্মার স্রোত পরিবর্তন এবং নদীর উজানে বিভিন্ন বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে গড়াই নদীর পানিপ্রবাহ দিন দিন হ্রাস পেয়েছে। বর্ষার মৌসুমে কিছু পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে নদী প্রায় খাল-নালার মতো হয়ে যায়।

নদীর তলদেশে অতিরিক্ত পলি পড়ায় এর নাব্যতা কমে গেছে। এর ফলে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জলজ উদ্ভিদ ও মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্তির পথে।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, নদীর এ অবস্থা মানবসৃষ্ট। সঠিকভাবে নদীর প্রবাহ বজায় না রাখায় এবং অযত্নে ফেলে রাখার কারণে আজ এ নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। নদী দখল, নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ এবং অপরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থাও নদীর অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

কৃষি ও অর্থনীতিতে প্রভাব

গড়াই নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে কৃষকরা সহজেই নদীর পানি ব্যবহার করে সেচ দিতেন। এখন তারা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ফলে কৃষকেরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।

এছাড়া নদীপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় অর্থনীতির গতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। একসময় নদী বেয়ে কুষ্টিয়া ও যশোরের বাজারে পণ্য যেত। আজ সবকিছু সড়কপথের ওপর নির্ভর করছে। এতে সময় ও খরচ দুটোই বেড়েছে। ছোট ছোট হাট-বাজার ও নৌঘাটগুলো বিলুপ্ত হয়েছে। স্থানীয় অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

যদিও গড়াই নদী আজ মৃতপ্রায়, তবু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এটিকে পুনর্জীবিত করা সম্ভব। সঠিক নদী-সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা হলে নদীতে আবারও প্রাণ ফিরতে পারে। নদী খনন, ড্রেজিং ও বাঁধ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

এছাড়া নদী ব্যবহারের জন্য আধুনিক পরিকল্পনা নিতে হবে। নদী যদি পুনর্জীবিত হয় তবে সেচ ব্যবস্থায় উন্নতি হবে, কৃষি খরচ কমবে এবং মাছ উৎপাদন বাড়বে। একই সঙ্গে নৌপথ চালু হলে পণ্য পরিবহন সহজ হবে। পর্যটন খাতেও এ নদীকে ব্যবহার করা সম্ভব। নৌকাবাইচ, নদীপাড়ে অবকাশকেন্দ্র এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠতে পারে।

পরিবেশবিদরা বলেন, নদী বাঁচলে প্রকৃতি বাঁচবে। গড়াই নদীর পুনর্জাগরণ শুধু অর্থনীতিই নয়, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকেও রক্ষা করবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকেও সচেতন হতে হবে। নদীকে দখলমুক্ত রাখা, অপরিকল্পিত বাঁধ বন্ধ করা এবং সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে।

গড়াই নদী দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনে অমূল্য সম্পদ। একসময় এটি ছিল অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও পরিবেশের প্রাণ। আজ এটি মৃতপ্রায় হলেও, সঠিক উদ্যোগ নিলে গড়াই নদীকে আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। নদী কেবল পানির উৎস নয়, এটি একটি সভ্যতার প্রতীক। গড়াই নদীর পুনর্জাগরণ মানে স্থানীয় মানুষের আশা, জীবিকা ও ইতিহাসকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলা।