শীর্ষ শিশু হাসপাতালের স্বীকৃতি
কানাডার টরন্টোতে অবস্থিত হসপিটাল ফর সিক চিলড্রেন, বা জনপ্রিয়ভাবে পরিচিত ‘সিককিডস’, আবারও বিশ্বের সেরা শিশু হাসপাতাল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। নিউজউইকের বিশ্বসেরা বিশেষায়িত হাসপাতাল তালিকায় এটি তৃতীয়বারের মতো শীর্ষে উঠল। ২০২১ ও ২০২২ সালেও সিককিডস প্রথম হয়েছিল, তবে তিন বছর ধরে রানারআপ অবস্থানে থাকার পর এবার ফের প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
১৮৭৫ সালে কানাডার প্রথম শিশু হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু করার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি গবেষণাধর্মী চিকিৎসায় দেশটির শীর্ষস্থানে রয়েছে এবং বিশ্বেও শীর্ষ তিনের মধ্যে গণ্য হয়। গত দেড়শো বছরে তারা ক্যানসার স্টেম সেল ও সিস্টিক ফাইব্রোসিসের জেনেটিক কারণ আবিষ্কারের মতো বড় বৈজ্ঞানিক সাফল্য অর্জন করেছে।

অঙ্গ প্রতিস্থাপনে পথিকৃৎ
আজ সিককিডস পুরো কানাডার শিশু অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অর্ধেকের বেশি সম্পন্ন করে। এর মধ্যে রয়েছে দেশের ৭৫ শতাংশ লিভার প্রতিস্থাপন, ৬০ শতাংশ হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন এবং অর্ধেকের বেশি অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন।
প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ও সিইও ড. রোনাল্ড কোহেন বলেন, “বিশ্বসেরা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া আমাদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এটি প্রতিটি কর্মীর নিবেদন ও পরিশ্রমের প্রতিফলন।”
‘প্রিসিশন চাইল্ড হেলথ’ মডেল
সিককিডসের প্রায় তিন ডজনের বেশি বিভাগ রয়েছে, কিন্তু সবার লক্ষ্য এক—‘প্রিসিশন চাইল্ড হেলথ’। এখানে শিশুর অসুস্থতার কারণ বোঝার জন্য জেনেটিক তথ্য থেকে শুরু করে তাদের বসবাসের এলাকা পর্যন্ত প্রতিটি তথ্য বিবেচনা করা হয়।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার
হাসপাতালের সিমুলেশন সেন্টারে রয়েছে বাস্তব শিশুর মতো দেখতে ‘গুয়েন’ নামের একটি পুতুল, যাকে চিকিৎসকরা প্রশিক্ষণ ও রোগ নির্ণয়ে ব্যবহার করেন। পাশের কক্ষে রয়েছে ‘এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টার ফর সিমুলেশন’, যেখানে ভিডিও ও অডিও বিশ্লেষণ করে কর্মীরা নিজেদের দক্ষতা উন্নত করেন।
আরও রয়েছে আধুনিক ‘হলডেক’, যেখানে রোগী ও পরিবার বাস্তবসম্মত পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। যেমন—একটি এমআরআই টিউবে প্রবেশ করার অভিজ্ঞতা বা বাসায় সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ শনাক্তকরণ।
জরুরি চিকিৎসায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
শিশু জরুরি বিভাগের ড. দেবিন সিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে শিশুদের দ্রুত সেবা দেওয়ার উপায় বের করছেন। ইতিমধ্যে পরিবারগুলো অনলাইনে জরুরি বিভাগের অপেক্ষার সময় জানতে পারছে। নতুন ড্যাশবোর্ড চালু হলে ভিড়ের সময় পূর্বাভাসও দেওয়া যাবে।
সিং আরও গবেষণা করছেন কীভাবে ট্রায়াজ ডেটা ব্যবহার করে আগে থেকেই পরীক্ষার নির্দেশনা দেওয়া যায়। যেমন—অ্যাপেন্ডিসাইটিস বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে আল্ট্রাসাউন্ড বা ইউরিন টেস্টের ব্যবস্থা করা। এতে রোগ নির্ণয় দ্রুত হয় এবং প্রয়োজনে দ্রুত অস্ত্রোপচারের সুযোগ তৈরি হয়।
হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরার প্রস্তুতি
ড. কোহেনের প্রিয় একটি উদ্যোগ হলো ‘কানেক্টেড কেয়ার’ প্রোগ্রাম। এর লক্ষ্য শিশুদের হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরার পথ সহজ করা। পরিবারকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তারা বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস অর্জন করে। নার্সরা শিশুর শয্যার পাশে অভিভাবকদের সঙ্গে ড্রেস রিহার্সাল করেন যাতে বাড়িতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে তারা প্রস্তুত থাকেন।

কোহেন বলেন, “এটি প্রযুক্তি নির্ভর না হলেও অত্যন্ত কার্যকর। পরিবারকে নিরাপত্তা বোধ দেওয়াই আসল সাফল্য।”
শিশুদের জন্য আনন্দের আয়োজন
হাসপাতালের মার্নি’স লাউঞ্জে রয়েছে ভিডিও গেম, পুল টেবিল ও গয়না বানানোর স্টেশন। এখানে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, আর শিশুদের মন ভালো থাকে। রান্নাঘরে কখনও কখনও রোগী ও পরিবারকে নিয়ে খাবার রান্না হয়—এক কিশোর একবার বাড়ির খাবারের অভাবে না খেয়ে ছিল, কিন্তু মায়ের সঙ্গে প্রিয় ভিন্ডি রান্না করার পর খাওয়া শুরু করে।
মার্নি’স স্টুডিও থেকে সম্প্রচারিত লাইভ অনুষ্ঠানে শিশুরা বিছানায় থেকেও অংশ নিতে পারে। এতে অতিথি হিসেবে এসেছেন রায়ান রেনল্ডস, শন মেন্ডেসসহ খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা।
রোগী ও পরিবারের কণ্ঠস্বর
হাসপাতালের ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যারেন কিনেয়ার বলেন, অতীতে পরিবারগুলো অভিযোগ করত তাদের মতামত শোনা হলেও কাজে লাগানো হয় না। তাই এখন সত্যিকারের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কৌশল নেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের সিইও কোহেন ‘রাউন্ডস উইথ রনি (Rounds with Ronnie)’ কর্মসূচি চালু করেছেন। সপ্তাহে কয়েকবার তিনি সরাসরি চিকিৎসক ও নার্সদের সাথে কথা বলেন, তাদের অভিজ্ঞতা শোনেন। তিনি বলেন, “কখনও কখনও শুধু স্বীকার করে নেওয়া যে, কাজটা কঠিন, সবার জন্যই বড় সহায়তা হয়।”

মানবিক উষ্ণতা
ড. কোহেন বলেন, “সিককিডস আসলে মানুষের অঙ্গন। এখানে সবাই কাজ করতে গর্ববোধ করে, একে অপরের প্রতি সম্মান ও আস্থার পরিবেশ রয়েছে।”
হাসপাতালের ভেতরের সেই উষ্ণতা এতটাই অনুভূত হয় যে, বাইরে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও আশার আলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















