এশিয়া কাপে দাপুটে পারফরম্যান্সের পাশাপাশি নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে তরুণ ভারতীয় দলের নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন সূর্যকুমার যাদব। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি পাকিস্তান ক্রিকেটারদের সঙ্গে করমর্দন না করার বিতর্কিত অবস্থান, কোচ গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে সম্পর্ক ও আড়াল থেকে সাজানো জয়ের নকশা, আর রবিবারের শেষ মুহূর্তের রোমাঞ্চ নিয়ে কথা বলেছেন।
প্রশ্ন: শেষ মুহূর্তগুলো কীভাবে সামলাচ্ছিলেন?
উত্তর: সত্যি বলছি, মিথ্যা বলব না—৮-৯ ওভারের পর আমি ড্রেসিংরুমের ভেতরে ঢুকে পড়ি। ভেতর থেকেই ম্যাচ দেখেছি। কোথায় বসি, কোথায় দাঁড়াই—নানাভাবে চেষ্টা করছিলাম। কুসংস্কারগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম, এখানে-ওখানে পায়চারি করছিলাম।
তিলক (ভার্মা) আর সঞ্জু স্যামসনের গুরুত্বপূর্ণ জুটি জমার পর কিছুটা স্বস্তি পাই। দুবে যখন নামল, জানতাম কাজটা সে পারবে। দুবে আর তিলকেরও ভাল জুটি হলো।
চাপ তো ছিলই। মাঠে খেললে চাপ কম থাকে; ড্রেসিংরুমে বসে দেখলে মাথার ভেতরটা বদলে যায়! তখন মনে হয়—ব্যাটসম্যানের মাথায় এখন কী চলছে, সে কী করবে… এসব ভাবনায় হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। সেই কাছাকাছি মুহূর্তগুলোর স্পন্দন কতটা তীব্র ছিল, তা একমাত্র আমিই জানি। হার্ট-রেট মনিটর পরা থাকলে ১৫০ পার করত!
প্রশ্ন: আপনি বলেছিলেন, ভারত-পাকিস্তান আর ‘রাইভ্যালরি’ নয়। ফাইনাল এত টানটান হওয়ার পর কি মনে হয়েছে, ‘এ কথা বলা উচিত হয়নি’?
উত্তর: না। ফাইনাল মানেই টানটান। অনেকে বলে—‘আরেকটা ম্যাচ’—কিন্তু ফাইনাল তো ফাইনালই। নকআউট, অনেক পরিশ্রমের ফল। তবু একবারও মনে হয়নি, আমি ভুল বলেছি। আমি আমার দলকে দেখি—প্র্যাকটিসে যেমন, ম্যাচে যেমন; জানি, তাদের স্কিল-লেভেল কী, যেকোনো পরিস্থিতিতে কীভাবে খেলতে পারে। সেটাই দেখে আমি ওই বক্তব্য দিয়েছি।
প্রশ্ন: টসের সময় প্রথম ‘করমর্দন না করার’ সিদ্ধান্ত—আপনি তো বেশ বন্ধুবৎসল, সবার সঙ্গে হাসিমুখে দেখা করেন। কীভাবে নিজেকে সামলালেন?
উত্তর: এটা সামলানোর বিষয় নয়। দেশের সঙ্গে চলাটা জরুরি। আগেই প্রেস কনফারেন্সে বলেছি—জীবনে স্পোর্টসম্যানশিপেরও ওপরে কিছু বিষয় থাকে। এটা তেমনই ছিল। অবস্থান নেওয়া খুবই জরুরি ছিল।
প্রশ্ন: ওই ম্যাচের পর আপনার দলও করমর্দন করেনি। ড্রেসিংরুমে ভাবনা-চিন্তা কেমন ছিল?
উত্তর: দলের সবাই একই কথা ভেবেছে—সূর্যও তাই ভেবেছে। পুরো দল ও সাপোর্ট স্টাফও একই মত ছিল। একবার যে অবস্থান নিয়েছি, সেটা বদলাব না।
প্রশ্ন: এভাবে কি ‘নো-হ্যান্ডশেক’ একটি ট্রেন্ড তৈরি করে ফেললেন?
উত্তর: সামনে কী হবে জানি না—‘দিল্লি এখনও অনেক দূর’। পাকিস্তানের সঙ্গে পরের ম্যাচে কী হবে, দেখা যাবে। আমরা তো যাই হোক, কেবল বহু-দেশীয় টুর্নামেন্টেই মুখোমুখি হই। যখন যা হবে, তখন দেখা যাবে। আপাতত আমরা এই মুহূর্তটাই উপভোগ করছি।
প্রশ্ন: প্রথম ম্যাচে করমর্দন না করার পর আপনাদের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছিল?
উত্তর: তেমন টেনশন ছিল না। আমরা ক্রিকেট খেলতে এসেছিলাম এবং ভাল ক্রিকেটই খেলেছি। ফল সবার সামনে। যদি অন্য কিছুতে—অর্থহীন ঝামেলায়—জড়িয়ে পড়তাম, তাহলে ফোকাস সরে যেত। তা হয়নি। ক্রিকেটেই ফোকাস ছিল। চাপের ভেতরেও সবাই লক্ষ্যেই মন দিয়েছে; জিতটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বাইরের শব্দ, চাপ—এসব কীভাবে সামলালেন?
উত্তর: জানতাম অনেক শব্দ হবে। হোয়াটসঅ্যাপ এড়ানো যায় না, যোগাযোগের মাধ্যম বলে। তবু এখানে আসার আগে ফোন থেকে সব সোশ্যাল মিডিয়া—ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ফেসবুক—মুছে দিয়েছিলাম। ফোনে থাকলে মানুষ মেসেজ দেখেই ফেলে—এটা স্বাভাবিক। রোহিত (শর্মা) আর ওর স্ত্রী (রীতিকা)-র সঙ্গে কথা বলেছিলাম—তিনি বলেন, বড় ম্যাচের আগে রোহিত ফোন থেকে সব সোশ্যাল অ্যাপ বন্ধ করে দেয়। আমিও সেটা অনুসরণ করেছি, সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়েছে।
প্রশ্ন: ফাইনালের টার্নিং পয়েন্ট কী ছিল?
উত্তর: ওরা ১১৩/১ ছিল; সেখান থেকে অলআউট ১৪৬—এই ফেরাটাই বড়। তারপর আমাদের ব্যাটিংয়ে তিলক-সঞ্জুর জুটি, আর তিলক-দুবে-র জুটি। যদি একটা জায়গা বাছতে হয়—বোলারদের কামব্যাকই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১২-১৩ ওভারে ১১৩/১ থেকেও তাদের ১৪৬-এ থামানো।
প্রশ্ন: গত রাত আর পুরো টুর্নামেন্ট—কেমন গেল?
উত্তর: অনেক কিছু চলছিল। প্রথমবার দেখলাম, এশিয়া কাপে এত অংশগ্রহণ, এত এনার্জি। আগে এশিয়া কাপ খেলেছি যেন সাধারণ দ্বিপাক্ষিক সিরিজের মতো। এবার অনেক কিছু জড়িয়ে ছিল—আগ্রাসন, দায়িত্ব… সব মিলিয়ে খেলতে দারুণ লেগেছে; একেবারে আইসিসি টুর্নামেন্টের আবহ।
প্রশ্ন: ট্রফি হাতে না দিয়েও উদ্যাপন কেমন হলো?
উত্তর: প্রায় এক ঘণ্টা ড্রেসিংরুমেই ছিলাম—আলাপ, মজা। কারও ভোরের ফ্লাইটও ছিল। এরপর সবাই নিজের নিজের এআই-ট্রফি বানিয়ে ফেলল! রূপার ট্রফি না পেলেই বা কী—আমরা কীভাবে ক্রিকেট খেলেছি, তাতে তার সংজ্ঞা বদলায় না। সব বিভাগেই ভাল করেছি। যেমন হার্দিক না থাকায় শিবম (দুবে) দায়িত্ব নিয়েছে। ছোটদের এভাবেই বড় করা হয়—খেলাতে হবে, বারবার ভরসা দিতে হবে। পানিতে না ফেললে কী করে বোঝা যাবে, ১০ ফুট গভীরতায় সাঁতার কেটে উঠতে পারে কি না!
প্রশ্ন: ফাইনালের আগে অপরাজিত ছিলেন—‘ল অফ অ্যাভারেজ’ ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল?
উত্তর: আমরা অনেকবারই অপরাজিত থেকেছি, টি২০ বিশ্বকাপসহ। কাজেই ওটা আমাদের পক্ষে ভাল সংকেত—অপরাজিত মানে কিছু না কিছু ঠিক করছি।
প্রশ্ন: ব্যক্তিগতভাবে—অধিনায়কত্ব কি ব্যাটিংকে প্রভাবিত করছে?
উত্তর: হালকা শুরু পাই, তারপর যেন ‘গাড়ি বন্ধ’। শট খেলছি, থামাইনি। ফর্ম নেই—এটা বলব না; বলব, রান আসেনি। অধিনায়কত্বের চাপ নেই। রোহিত ভাইকে দেখুন—ক্যাপ্টেন্সিতে আরও খোলামেলা ব্যাট করেছে। ছোট একটা বাধা আছে, আমি পার হয়ে যাব। ঈশ্বর ঠিক সময়ের জন্যই সব রেখে দিয়েছেন।
প্রশ্ন: এই ভারতীয় দলে ক্রিকেটীয় সংস্কৃতিটা কেমন?
উত্তর: ওপরে অভিষেক আর গিল যেমন খেলে, ৩ বা ৪ নম্বরে নেমে আমিও তেমনই খেলব। এখন ভাবব না, ৪০-৫০ বা ১০০ করতেই হবে। ১২-১৫ বলে কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারি—সেটা দেখব। আমরা দলে এই ট্রেন্ডটাই সেট করেছি। দলে ৭-৮ ব্যাটার—তাদের মধ্যে ৪-৫ জন কাজটা করে দিলে আমরা এমন একটা স্কোরে পৌঁছাই, যা বোলাররা ডিফেন্ড করতে পারে। ‘অ্যাঙ্কর করে শেষ পর্যন্ত খেলতেই হবে’—এটা আর চলবে না। পরিস্থিতি এলে সেভাবেই খেলব—যেমন তিলক গতকাল খেলেছে।
প্রশ্ন: রান তাড়ার সময় তিলককে কী বার্তা দেওয়া হয়েছিল?
উত্তর: গৌতি ভাই (গৌতম গম্ভীর) বার্তা পাঠিয়েছিলেন—‘লম্বা খেলো; তুমি থাকলে কাজ হয়ে যাবে।’ তিলকের জন্য খুব খুশি, সবাই দেখেছে সে কী করতে পারে।
প্রশ্ন: অভিষেকের আগ্রাসী ব্যাটিং নিয়ে…
উত্তর: গৌতি ভাই আর আমি দু’জনেই বলেছি—নিজের খেলা বদলাবে না, নিজের পরিচয়টা বদলাবে না। এই পরিচয়ই তো তাকে এখানে এনেছে। নিজেকে, নিজের স্কিলকে ব্যাক করো। দলের দৃষ্টিকোণ থেকে ও অনেক পার্থক্য গড়ে দেবে। প্রথম বলেই ঝুঁকিপূর্ণ শটে আউট হলে কোনও অসুবিধা নেই। টি২০ তো হাই-রিস্ক, হাই-রিওয়ার্ড ফরম্যাট। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ও ঝুঁকি নিয়েছে, প্রচুর পুরস্কারও পেয়েছে।
প্রশ্ন: গম্ভীরের ভূমিকা?
উত্তর: উনি পর্দার আড়ালে কাজ করেন—সবাইকে সাহায্য করেন, সমর্থন দেন। কালও বলেছিলেন—নতুন বলে শিবম দুবেকে ট্রাই করতে। পুরো টুর্নামেন্টে নতুন বলে সে বল করেনি। গম্ভীর পর্দার পেছনে কাজ করতেই পছন্দ করেন, সামনে আসতে চান না। খেলা বোঝেন, চাপের পরিস্থিতি বোঝেন, এগুলো কীভাবে কাজ করে জানেন। আমাদের গাইড করার জন্য তিনিই ছিলেন সেরা ব্যক্তি।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন—গত রাত থেকে ফোনে কতগুলো মেসেজ?
উত্তর: ৪০০-৫০০-রও বেশি আনরিড মেসেজ। টি২০ বিশ্বকাপের মতোই—এবারও মেসেজ-ফ্লাড!
( ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে অনূদিত)