গাজা সংঘাতের অবসান ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য একটি ‘সমগ্র পরিকল্পনা’র খসড়া তুলে ধরা হয়েছে। পরিকল্পনাটির লক্ষ্য—গাজাকে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসমুক্ত রাখা, প্রতিবেশীদের জন্য হুমকিমুক্ত করা এবং গাজার মানুষের কল্যাণে পুনর্গঠন করা। পরিকল্পনার সারাংশ ও ধাপগুলো নিচে উপস্থাপিত হলো।
প্রধান প্রস্তাব
গাজা নতুনভাবে গড়ে তোলা হবে গাজার মানুষের কল্যাণে। উভয় পক্ষ এই প্রস্তাবে সম্মত হলে যুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হবে। ইসরায়েলি বাহিনী জিম্মিমুক্তির প্রস্তুতির জন্য নির্ধারিত রেখা পর্যন্ত সরে দাঁড়াবে। এই সময়ে বিমান ও কামান হামলাসহ সব ধরনের সামরিক অভিযান স্থগিত থাকবে এবং ধাপে ধাপে পূর্ণ প্রত্যাহারের শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রের সীমারেখা অপরিবর্তিত থাকবে।
বন্দিমুক্তি ও বিনিময়
চুক্তি প্রকাশ্যে গ্রহণের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব বন্দি—জীবিত ও মৃত—ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এরপর যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫০ জন বন্দি এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর আটক ১,৭০০ জন গাজাবাসীকে মুক্তি দেওয়া হবে, যার মধ্যে ওই প্রেক্ষাপটে আটক সব নারী ও শিশুও থাকবে। যেসব ইসরায়েলি জিম্মির মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে ১৫ জন মৃত গাজাবাসীর মরদেহ ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
সাধারণ ক্ষমা ও নিরাপদ প্রস্থান
সব বন্দি ফেরত আসার পর, যারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অঙ্গীকার করবে এবং অস্ত্র সমর্পণ করবে—এমন হামাস সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা দেওয়া হবে। যারা গাজা ত্যাগ করতে চায়, তাদের গ্রহণকারী দেশে নিরাপদে পৌঁছানোর ব্যবস্থা থাকবে।
মানবিক সহায়তা ও পুনর্গঠন
চুক্তি গৃহীত হওয়ার সাথে সাথে গাজা উপত্যকায় অবিলম্বে পূর্ণমাত্রার ত্রাণ প্রবেশ করবে। ন্যূনতম মানদণ্ড হিসেবে ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারির মানবিক সহায়তা চুক্তিতে নির্ধারিত পরিমাণ ও ক্ষেত্র অন্তত বজায় থাকবে। এর মধ্যে অবকাঠামো (পানি, বিদ্যুৎ, পয়োনিষ্কাশন) পুনর্বাসন, হাসপাতাল ও বেকারি পুনর্বাসন, ধ্বংসস্তূপ অপসারণ এবং সড়ক খুলে দেওয়ার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ত্রাণ আনা ও বিতরণে কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ থাকবে না; জাতিসংঘ ও তার সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট এবং উভয় পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কহীন অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এ কাজ সম্পন্ন করবে। রাফাহ ক্রসিং উভয়মুখী খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ২০২৫ সালের ১৯ জানুয়ারির চুক্তির প্রক্রিয়াই অনুসরণ করা হবে।
অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থা
গাজা একটি অন্তর্বর্তীকালীন, অরাজনৈতিক ও টেকনোক্র্যাটিক ফিলিস্তিনি কমিটির অধীনে সাময়িকভাবে পরিচালিত হবে—যা দৈনন্দিন জনসেবা ও পৌরসেবা দেখভাল করবে। এই কমিটি যোগ্য ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত হবে। তাদের ওপর তদারকি করবে একটি নতুন আন্তর্জাতিক অন্তর্বর্তী সংস্থা “বোর্ড অব পিস”—যার প্রধান ও চেয়ারম্যান থাকবেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প; অন্যান্য সদস্য ও রাষ্ট্রপ্রধানদের নাম পরে ঘোষণা করা হবে, যার মধ্যে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও থাকবেন।
পুনর্গঠন ও অর্থায়ন কাঠামো
উক্ত সংস্থা গাজার পুনর্গঠনের জন্য কাঠামো তৈরি ও অর্থায়ন তদারকি করবে—যতদিন না ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (PA) প্রয়োজনীয় সংস্কার কর্মসূচি সম্পন্ন করে নিরাপদ ও কার্যকরভাবে গাজার নিয়ন্ত্রণ পুনর্গ্রহণে সক্ষম হয়। আন্তর্জাতিক সেরা মানদণ্ড অনুসরণ করে একটি আধুনিক, কার্যকর শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ হবে—যা গাজার মানুষের সেবা করবে এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করবে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি আধুনিক ‘অলৌকিক’ শহর নির্মাণে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গাজা পুনর্গঠন ও অর্থনীতিকে গতিশীল করতে একটি ‘ট্রাম্প অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা’ প্রণয়ন করা হবে। সদিচ্ছাপূর্ণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর বিনিয়োগ প্রস্তাব ও উন্নয়ন ধারণা বিবেচনা করে নিরাপত্তা ও শাসন কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হবে—যা কর্মসংস্থান, সুযোগ ও আশার সঞ্চার করবে। পাশাপাশি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে; অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সেখানে অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক ও প্রবেশাধিকার নির্ধারণ করা হবে।
জনগণের চলাচল ও স্বেচ্ছাচারবিরোধী নিশ্চয়তা
কাউকে গাজা ছাড়তে বাধ্য করা হবে না। যারা যেতে চান—যাবেন এবং ইচ্ছা করলে ফিরে আসতে পারবেন। মানুষকে থাকা ও উন্নত গাজা গড়তে উৎসাহিত করা হবে।
হামাসের ভূমিকা ও নিরস্ত্রীকরণ
হামাস ও অন্যান্য দল গাজা শাসনে কোনোভাবেই—সরাসরি, পরোক্ষ বা অন্য কোনো রূপে—অংশ নেবে না বলে সম্মত হবে। সব সামরিক, সন্ত্রাসী ও আক্রমণাত্মক অবকাঠামো—টানেল ও অস্ত্র উৎপাদন কারখানাসহ—ধ্বংস করা হবে এবং পুনর্গঠন করা হবে না। স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে গাজার নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া চালু থাকবে; এতে সমঝোতাভিত্তিক অস্ত্রসমর্পণ ও স্থায়ীভাবে অস্ত্র অকার্যকর করার ব্যবস্থা থাকবে। এই কর্মসূচি আন্তর্জাতিকভাবে অর্থায়িত অস্ত্র ক্রয়-বাইব্যাক ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা দ্বারা সমর্থিত হবে এবং সবকিছু স্বাধীন পর্যবেক্ষকের মাধ্যমে যাচাই করা হবে। ‘নিউ গাজা’ শক্তিশালী অর্থনীতি গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে।
আঞ্চলিক নিশ্চয়তা
আঞ্চলিক অংশীদারেরা নিশ্চয়তা দেবে—হামাস ও সংশ্লিষ্ট দলসমূহ তাদের অঙ্গীকার পূরণ করবে এবং ‘নিউ গাজা’ তার প্রতিবেশী বা নিজ জনগণের জন্য কোনো হুমকি সৃষ্টি করবে না।
সাময়িক আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (ISF)
যুক্তরাষ্ট্র আরব ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করে একটি সাময়িক আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী (ISF) গঠন করবে—যা অবিলম্বে গাজায় মোতায়েন হবে। ISF যাচাই-সাপেক্ষে বাছাইকৃত ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেবে এবং এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ জর্ডান ও মিসরের সঙ্গে পরামর্শ করবে। এই বাহিনী দীর্ঘমেয়াদি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সমাধান হিসেবে কাজ করবে। ISF ইসরায়েল ও মিসরের সঙ্গে সমন্বয় করে সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে—নতুন প্রশিক্ষিত ফিলিস্তিনি পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে। গাজায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রবেশ ঠেকানো এবং পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবনের জন্য পণ্যদ্রব্যের দ্রুত ও নিরাপদ প্রবাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পক্ষসমূহের মধ্যে একটি ‘ডি-কনফ্লিকশন’ ব্যবস্থায় সমঝোতা হবে।
ইসরায়েলি বাহিনীর ধাপে ধাপে সরে দাঁড়ানো
ইসরায়েল গাজা দখল বা সংযুক্ত করবে না। ISF যখন নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করবে, তখন ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (IDF) নিরস্ত্রীকরণের মানদণ্ড, মাইলফলক ও সময়সীমার ভিত্তিতে—যা IDF, ISF, গ্যারান্টর দেশসমূহ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতায় নির্ধারিত হবে—ধাপে ধাপে পিছু হটবে। বাস্তবে, IDF তাদের দখলে থাকা গাজার এলাকা ধাপে ধাপে ISF-এর কাছে হস্তান্তর করবে—অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি অনুযায়ী—এবং শেষপর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে গাজা থেকে প্রত্যাহার করবে। তবে একটি নিরাপত্তা পরিমিতি (সিকিউরিটি পেরিমিটার) উপস্থিতি থাকবে, যতক্ষণ না গাজা কোনো সন্ত্রাসী হুমকি থেকে যথাযথভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রত্যাখ্যান বা বিলম্বের পরিস্থিতি
যদি হামাস এই প্রস্তাব বিলম্বিত করে বা প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে উপরে বর্ণিত ব্যবস্থা—বর্ধিত ত্রাণ কার্যক্রমসহ—IDF থেকে ISF-এর কাছে হস্তান্তরিত সন্ত্রাসমুক্ত এলাকাগুলোতে বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে।
আন্তধর্মীয় সংলাপ
সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি আন্তধর্মীয় সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে—যার লক্ষ্য ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের মানসিকতা ও বয়ানকে বদলে দেওয়া এবং শান্তির সুফলগুলোর ওপর জোর দেওয়া।
রাজনৈতিক দিগন্ত ও রাষ্ট্রসত্তা
গাজার পুনর্গঠন অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে এবং যখন PA-র সংস্কার কর্মসূচি নিষ্ঠার সঙ্গে বাস্তবায়িত হবে, তখন ফিলিস্তিনিদের কাঙ্ক্ষিত আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রসত্তার দিকে একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ উন্মোচিত হওয়ার শর্ত সৃষ্টি হতে পারে—যা ফিলিস্তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংলাপ শুরু করবে—শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী সহাবস্থানের জন্য একটি রাজনৈতিক দিগন্ত নির্ধারণে।
(উৎস: হোয়াইট হাউস কর্তৃক প্রকাশিত খসড়া/রূপরেখা)