সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও দীর্ঘদিনের সংসদ সদস্য নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন আর নেই। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ঢাকার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই রাজধানী থেকে শুরু করে নরসিংদীর প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত নেমে আসে শোকের ছায়া।
পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল ১১টায় মনোহরদী উপজেলার শুকুর মাহমুদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয় তার দ্বিতীয় জানাজা। বিশাল মাঠ উপচে পড়ে মানুষে মানুষে। হাজার নয়, লাখো মানুষের ঢল নামল প্রিয় নেতাকে শেষবারের মতো বিদায় জানাতে। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে।
এই দৃশ্য দেখে স্পষ্ট হয়, রাজনৈতিক বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষের ভালোবাসা ও আস্থা আজও তার প্রতি অটুট। লাখো মানুষের এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অর্জিত জনপ্রিয়তারই প্রতিফলন।
জন্ম ও শিক্ষা
নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ১৯৫০ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার গোতাশিয়ার বাগানবাড়ী গ্রামে। তিনি সেন্ট গ্রেগরির উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএসএস এবং আইন বিভাগ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন।
ছাত্ররাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ
শিক্ষাজীবনেই তিনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতিকে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ছাত্রনেতা হিসেবে মুক্তিকামী তরুণদের সংগঠিত করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকেন। তার এই ভূমিকা তাকে নরসিংদী ও ঢাকার তরুণদের কাছে একজন সাহসী নেতৃত্বের প্রতীক করে তোলে।
যুবলীগে সম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক উত্থান
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি আওয়ামী যুবলীগে যুক্ত হন এবং যুবসমাজকে সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। যুবলীগের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
এই সময় থেকেই তার রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি গড়ে ওঠে জনগণকেন্দ্রিক। শিক্ষা, উন্নয়ন, সামাজিক অবকাঠামো—সবখানেই তার আগ্রহ ছিল প্রবল। ফলে আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে তার একটি গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি তৈরি হয়।
আইনজীবী থেকে সংসদ সদস্য
আইনজীবী পেশার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তাকে জাতীয় রাজনীতির দিকে নিয়ে আসে।
১৯৮৬ সালে নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তার স্বাধীন প্রার্থী হিসেবেই জয় লাভ তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে স্পষ্ট করে।
এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হন।
মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এ সময়ে বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ খাতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে এগিয়ে নিতে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে এবং শিল্পাঞ্চল আধুনিকীকরণে তার অবদান রয়েছে।
২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ে শিল্পখাতে নীতি প্রণয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বিতর্কিত অধ্যায়
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি যেমন জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি বিতর্কের মুখোমুখিও হয়েছেন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর তাকে গুলশান থেকে র্যাব গ্রেফতার করে। নরসিংদীতে একটি হত্যা মামলায় তার নাম আসায় তিনি কারাগারে আটক ছিলেন। এছাড়া তার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা দায়ের করে।
মৃত্যু ও শেষ বিদায়
কারাগারে থাকার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ২০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর ঢাকার আজাদ মসজিদে প্রথম জানাজা এবং নরসিংদীতে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
মনোহরদীর জানাজাস্থল পরিণত হয় জনসমুদ্রে। গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, তরুণ-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-নারী—সকলেই অশ্রুসিক্ত চোখে শেষ বিদায় জানায় প্রিয় মানুষটিকে।
জনতার অশ্রুসিক্ত অনুভূতি
মনোহরদীর বৃদ্ধ রিকশাচালক আব্দুল কুদ্দুস বলেন,
“ছেলেবেলা থেকে উনাকে চিনি। এলাকার স্কুলে, রাস্তাঘাটে সবখানেই তার অবদান আছে। আমরা তাকে হারালাম মানে আমাদের অভিভাবককে হারালাম।”
জানাজাস্থলে উপস্থিত এক তরুণী শিক্ষার্থী নাহিদা বলেন,
“আমার দাদার মুখে শুনেছি, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি হয়েছিলেন। এত বড় মানুষ হয়েও তিনি গ্রামের মাটিতে পা রেখেছিলেন। তাই আমরা তাকে ভুলব না।”
পরিবারের প্রতিক্রিয়া
দাফন শেষে মরহুমের ছেলে মাহমুদুল হক বলেন,
“আব্বা আমাদের শুধু পরিবার নয়, এই এলাকারও অভিভাবক ছিলেন। রাজনীতির চাপে আমাদের সময় দিতে পারেননি সবসময়, কিন্তু মানুষের জন্য কাজ করতে কখনও বিরতি দেননি। আজকের এই জনসমাগম প্রমাণ করে, মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসত।”
সহকর্মীদের স্মৃতিচারণ
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন,
“তিনি শুধু রাজনীতিবিদ নন, একজন সমাজসেবকও ছিলেন। এলাকার শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান অবিস্মরণীয়।”
একজন সাবেক সংসদ সদস্য সহকর্মী বলেন,
“জাতীয় সংসদে তিনি দৃঢ়ভাবে কথা বলতেন। শিল্পোন্নয়নের জন্য সাহসী নীতি প্রণয়নে তার ভূমিকা ভুলে যাওয়া যাবে না।”
জনপ্রিয়তার প্রতিফলন
দাফনের দিন মনোহরদীর আকাশ ভারী হয়ে উঠেছিল অশ্রুসিক্ত বিদায়ে। রাজনৈতিক জীবন ছিল আলো-অন্ধকারে ভরা, কিন্তু শেষ সময়ে তাকে ঘিরে মানুষের আবেগ দেখিয়েছে—একজন নেতার প্রকৃত পরিচয় তৈরি হয় তার কর্ম দিয়ে, মামলার কাগজ দিয়ে নয়।
রাজনীতির দীর্ঘ লড়াই, ছাত্ররাজনীতি ও যুবলীগের দিনগুলো, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, মন্ত্রীত্বের গৌরব কিংবা বিতর্কের ঝড়—সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে নরসিংদীর মাঠভর্তি মানুষের ভালোবাসা। সেই দৃশ্য প্রমাণ করেছে, লাখো মানুষের শ্রদ্ধা প্রদর্শন নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের অটল জনপ্রিয়তারই প্রতিফলন, যা মৃত্যুর পরও তাকে মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত করে রেখেছে।