কামিকাজে ড্রোনে আতঙ্কিত শহর
ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের শহর ক্রামাতোর্স্ক ও স্লোভিয়ানস্কে প্রতিদিনই আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে রাশিয়ার আত্মঘাতী ড্রোন। লক্ষ্যবস্তু খুঁজতে থাকা এসব ড্রোন মানুষকে বাধ্য করছে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে—থাকা নাকি চলে যাওয়া।
২৯ বছর বয়সী ব্যবসায়ী ম্যাক্সিম লিসেনকো ক্রামাতোর্স্কে নিজের পোশাকের দোকান চালাচ্ছেন। দোকানের ভেতরেই হঠাৎ ড্রোনের শব্দ শুনে তিনি জানালার দিকে ঝুঁকে বলেন, “ওটা নামছে। বিস্ফোরণ হবে।” মুহূর্ত পরেই তীব্র শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। তিনি হাসতে হাসতেই বলেন, “এই তো ক্রামাতোর্স্ক!”
এক ঘণ্টারও কম সময়ে রাশিয়ান কামিকাজে ড্রোন তিনবার আক্রমণ চালায়। এ যেন প্রতিদিনের নতুন বাস্তবতা।
ক্রামাতোর্স্কে জীবনযাত্রা থেমে নেই
রাশিয়ান বাহিনী শহর থেকে ২০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থান করলেও অনেকেই এখনও থেকে গেছেন। লিসেনকোর দোকানে পোশাক কেনেন সৈন্য আর সাধারণ মানুষ। দোকানের দেয়ালে টাঙানো আছে বিভিন্ন সেনা ইউনিটের প্রতীক। তার প্রতিটি টিশার্টের বার্তা একই—“আমাদের অবশ্যই দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত হতে হবে।”
শহরের কেন্দ্রস্থলে এক বাজারে ড্রোন আঘাত করলে কয়েকজন আহত হয়। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে দোকানি জানান, তিনি কোথাও যাবেন না।
প্রতিরোধের শহর
লিসেনকো ছাড়াও আরও দুইজনকে দেখা গেল প্রতিরোধের ভিন্ন ভিন্ন কারণে শহরে উপস্থিত থাকতে।
২৫ বছর বয়সী দারকা হারনিক, যিনি জ্বালানি নিরাপত্তা পরিকল্পনায় কাজ করেন, বলেন, “আমি জানতাম একদিন এই শহর দখল হতে পারে। তাই আবার দেখতে এসেছি।” তিনি কিয়েভ থেকে ট্রেনে আসেন। ট্রেন স্টেশন থেকে নামতেই বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান।
কৃষক সের্হি কুরিনি, যিনি প্রজন্ম ধরে জমি চাষ করে আসছেন, বলেন, “যদি আমরা ডনবাস ছেড়ে দিই, রাশিয়া থামবে না। তারা খারকিভ, জাপোরিঝিয়া, খেরসন দখল করবে। এরপর ওডেসা চাইবে।”
জনমত ও যুদ্ধের বাস্তবতা
কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ৭৫ শতাংশ ইউক্রেনীয় রাশিয়ার প্রস্তাবিত শান্তি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে। ৬২ শতাংশ বলেছে, যতদিন লাগে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। মাত্র ১৮ শতাংশ আশা করছে এ বছর শান্তি আসবে।
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার ভূখণ্ড দখলের দাবি মানতে অস্বীকার করেছেন। তিনি যুদ্ধবিরতি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তার কথা বলছেন। অন্যদিকে, পুতিন ডনবাসের পুরো নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন ছাড়ছেন না।
ড্রোন যুদ্ধের নতুন হুমকি
স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কে আগে থেকেই রাশিয়ান মিসাইল হামলা চলছিল। এখন যুক্ত হয়েছে দ্রুতগতির আত্মঘাতী ড্রোন। এগুলো আঘাত হানছে বাজার, রাস্তা ও আবাসিক ভবনে।
রাস্তা দিয়ে যাতায়াতও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেক রাস্তায় সাইনবোর্ডে সতর্কবার্তা লেখা—“FPV ড্রোনের ঝুঁকি, বিকল্প পথ ব্যবহার করুন।” সেনারা গাড়িতে অ্যান্টি-ড্রোন জ্যামার বসাচ্ছে, চেকপোস্টে ঝুলছে জাল, হাতে হাতে আছে ড্রোন শনাক্তকারী যন্ত্র।
তবুও টিকে থাকার ইচ্ছাশক্তি
ভয়াবহ পরিস্থিতির মাঝেও কিছু মানুষ আশা হারাচ্ছেন না। দারকা হারনিক বলেন, “এমন সংকটেও শহর বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য।”
ম্যাক্সিম লিসেনকো আরও দৃঢ়ভাবে বলেন, “আমরা তিনবার আক্রমণ দেখেছি মাত্র আধ ঘণ্টায়। কিন্তু এই শহর কখনও রাশিয়ার পতাকার নিচে যাবে না, এটি থাকবে ইউক্রেনের পতাকার নিচে।”
মানুষের গল্প: প্রতিরোধের প্রতীক
- ম্যাক্সিম লিসেনকো: পোশাক ব্র্যান্ড ‘জাবোই’-এর মালিক। তিনি মনে করেন দোকান খোলা মানেই প্রতিরোধ। বলেন, “আমরা প্রমাণ করতে চাই ডনবাস ইউক্রেনের অংশ।”
- দারকা হারনিক: প্রাক্তন স্বেচ্ছাসেবক, এখন জ্বালানি নিরাপত্তা প্রকল্পে কাজ করেন। শহরের প্রতি আবেগী টানই তাকে বারবার ফিরিয়ে আনে।
- সের্হি কুরিনি: কৃষক, যিনি জমি ছাড়তে নারাজ। রাশিয়ান বাহিনী এলে তার পরিবারকে নির্যাতনের ঝুঁকির কথাও উল্লেখ করেন।
যুদ্ধের প্রতিদিনের ভয়াবহতা, ড্রোনের হুমকি আর সম্ভাব্য দখলের আশঙ্কা—সবকিছুর মাঝেও ক্রামাতোর্স্ক ও স্লোভিয়ানস্কের মানুষ তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। আতঙ্ক আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও শহরগুলোর অদম্য ইচ্ছাশক্তি বারবার প্রমাণ করছে—তারা এখনও হাল ছাড়েনি।